শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪ ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
Smoking
 
জঙ্গি আস্তানায় সবায় মারা যেতে পারে : র‌্যাব
প্রকাশ: ১০:১২ am ০৬-০৯-২০১৭ হালনাগাদ: ১০:২১ am ০৬-০৯-২০১৭
 
 
 


দিনভর চেষ্টার পরও রাজধানীর মিরপুরের বাড়িটিতে অবস্থানরত সন্দেহভাজন জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করানো যায়নি। বাড়িটি ঘিরে রাখার প্রায় ২০ ঘণ্টা পর গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে র‍্যাব জানায়, জঙ্গিরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়েছে। এর সোয়া তিন ঘণ্টা পর রাত পৌনে ১০টার দিকে পরপর তিনটি বড় ধরনের বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এরপর ওই বাড়ি থেকে আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে দেখা যায়।

র‍্যাবের কর্মকর্তাদের ধারণা, বাড়ির ভেতরে থাকা জঙ্গিরা নিজেরা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হয়েছেন। ওই বাড়িতে গৃহকর্তা আবদুল্লাহ, তাঁর দুই স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান এবং দুজন সহযোগী অবস্থান করছিলেন। এর মধ্যে আবদুল্লাহ একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি বলে গতকাল সকালে র‍্যাব সাংবাদিকদের জানিয়েছিল।

গতকাল রাত পৌনে ১১টার দিকে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘রাত পৌনে ১০টার দিকে আপনারা দেখতে পেয়েছেন, জঙ্গি যারা ভেতরে ছিল, তারা এ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আমাদের ধারণা, এটি রাসায়নিক বিস্ফোরণের মতো। পাঁচতলায় আগুনও লেগেছে। ফায়ার সার্ভিস সেটা নেভাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আগুন নেভানোর পরে আমাদের অভিযানের যে মানসম্মত অভিযান পদ্ধতি (এসওপি) দেওয়া আছে, তার আলোকেই ওই বাড়িতে তল্লাশি চালানো হবে। এরপরে বলা যাবে, সেখানে আসলে কতজন হতাহত হয়েছে। ওই ঘটনায় র‍্যাবের চারজন সদস্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছেন। তবে তাঁরা শঙ্কামুক্ত।’

র‍্যাবের মুখপাত্র বলেন, ‘সারা দিন চেষ্টা ছিল ভবনের নিরীহ নিরপরাধ লোকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেটা আমরা করেছি। সন্ধ্যায় আবদুল্লাহ আত্মসমর্পণ করবেন বলে আমাদের কাছে রাত আটটা পর্যন্ত সময় চেয়েছিলেন। আমরা সময় দিয়েছি। সাড়ে আটটার দিকে বললেন, তিনি নামাজ পড়ার সময় চান, আমরা দিলাম। এরপর তিনি আমাদের কাছে আরও আধা ঘণ্টা সময় চান। আমরা আরও ধৈর্য ধরলাম।’

সোমবার রাত ১১টায় মিরপুর মাজার রোডের বর্ধনবাড়ি এলাকায় ‘কমল প্রভা’ নামের বাড়িটি ঘেরাও করা হয়। বাড়ির পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিরা রয়েছে বলে র‍্যাব চিহ্নিত করে। পরে ওই বাড়ির বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

মিরপুরে জঙ্গি সন্দেহে ঘিরে রাখা বাড়িটি। সোমবার রাতে বাড়িটি থেকে জঙ্গিরা র‍্যাবকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ও পেট্রলবোমা হামলা করে বলে জানিয়েছে র‍্যাব l র‍্যাবের সৌজন্যে গতকাল বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় টাঙ্গাইলে একটি অভিযান হয়েছে। সেখানে দুই ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের একজন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ওই অভিযানের ফলোআপ হিসেবে সোমবার রাত ১১টার দিকে মিরপুর মাজার রোডে অভিযান শুরু হয়।

গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনাল থেকে মাজার রোড হয়ে কিলোমিটারখানেক গেলেই হাতের বাঁয়ে বর্ধনবাড়ি যাওয়ার রাস্তা। এ রাস্তা ধরে আনুমানিক দেড় কিলোমিটার গেলে পুলিশের দারুস সালাম অঞ্চলের সহকারী কমিশনারের কার্যালয়ের ঠিক সামনের গলির শেষ মাথায় হালকা হলুদ রঙের বাড়ি। নাম ‘কমল প্রভা’। এক প্রবাসীর মালিকানাধীন ছয়তলা ওই বাড়িতে ২৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ২৩টি ফ্ল্যাটের ৬৫ জন বাসিন্দাকে রাতেই সরিয়ে দারুস সালাম সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে তাঁরা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে যান। ‘কমল প্রভা’র সিকি কিলোমিটারের মধ্যে দারুস সালাম থানা হলেও পুরো অভিযানে পুলিশের তেমন অংশগ্রহণ দেখা যায়নি।

গতকাল সকালে মাজার রোড থেকে বর্ধনবাড়ি এলাকায় যাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ করে দেয় র‍্যাব। সংবাদকর্মীরা ঘুরে দিয়াবাড়ি হয়ে দারুস সালাম থানার কিছু আগে পর্যন্ত যেতে পারেন। র‍্যাব কর্মকর্তারা কিছুক্ষণ পরপর ঘটনা সম্পর্কে সংবাদকর্মীদের জানাচ্ছিলেন। আশপাশের এলাকায় মানুষের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ এবং দোকানপাট, চায়ের দোকান—সবকিছুই বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গতকাল দুপুরে র‍্যাবের মহাপরিচালক বলেন, এখানে যিনি আছেন তিনি একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি। ২০০৫ সাল থেকে তিনি জঙ্গিবাদে যুক্ত। এই এলাকায় ১০-১২ বছর ধরে তিনি বাস করছেন। তিনি আইপিএস ও ইউপিএসের ব্যবসা, ফ্রিজ মেরামত ও কবুতর ব্যবসার আড়ালে এখানে প্রচুর বিস্ফোরক ও দাহ্য রাসায়নিক জমা করেছেন। তাঁর কাছে ৫০-এর অধিক আইইডি (হাতে তৈরি বোমা) আছে বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন। সোমবার ভোর চারটা থেকে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা গেছে।

র‍্যাবের মহাপরিচালক বলেন, ‘সেখানে দুর্ধর্ষ জঙ্গি আবদুল্লাহ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাঁর দুই স্ত্রী, দুই শিশুসন্তান ও দুজন সহযোগী সেখানে থাকতে পারে। শিশুদের একটির বয়স আড়াই থেকে তিন বছর, আরেকটি ১০-১১ বছরের। নারী ও শিশুরা থাকার কারণে সরাসরি অ্যাসল্ট না করে নেগোসিয়েশনের (আলোচনার) মাধ্যমে তাদের আত্মসমর্পণ করানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। ওই চেষ্টা ব্যর্থ হলে বা জঙ্গিরা যদি র‍্যাবের ওপর আক্রমণ করে, তাহলে আইনগতভাবে বল প্রয়োগ করা হবে। তবে আবদুল্লাহ সময় চাইছেন, তিনি কালক্ষেপণ করছেন।’ তিনি বলেন, নানাভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা আত্মসমর্পণ করে। র‍্যাবের যা সামর্থ্য, তাতে সেখানে অভিযান চালালে সেটা ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বিষয়।

এর আগে সোমবার রাত দেড়টার দিকে র‍্যাবের মুখপাত্র মুফ‌তি মাহমুদ খান ব‌লেন, মাজার রো‌ডের বা‌ড়ি‌টি থে‌কে জ‌ঙ্গিরা র‍্যাব‌কে লক্ষ্য ক‌রে একাধিক আইইডি ও পে‌ট্রলবোমা ছু‌ড়েছে।

এদিকে স্থানীয় সাতজন বাসিন্দার সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, আবদুল্লাহর পরিবারটিকে তাঁরা প্রায় ১৫ বছর ধরে ওই এলাকায় দেখছেন। আবদুল্লাহর এক ভাই রয়েছেন, তাঁর নাম খোকা। ৩৪-৩৫ বছর বয়সী আবদুল্লাহকে এলাকার পুরোনো বাসিন্দারা প্রায় সবাই চেনেন। তাঁর আইপিএসের ব্যবসা রয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের খামারে কয়েক শ কবুতর রয়েছে। সেখানে অনেক দামি কবুতরও রয়েছে, যার এক জোড়ার দাম ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এলাকায় আবদুল্লাহরা দুই ভাই ক্রীড়ামোদী হিসেবেও পরিচিত। বিশ্বকাপসহ বিভিন্ন খেলার সময় তাঁরা প্রিয় দলের সমর্থনে নানা কর্মকাণ্ড করেন এলাকায়। আবদুল্লাহর ১০ বছরের ছেলে ওসামা ও ৪ বছরের ছেলে ওমরকেও অনেকেই চেনেন। তাদের থানার সামনের খেলার মাঠে নিয়মিত দেখা যায়।

কমল প্রভা নামের ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে বসবাসকারী এক ব্যক্তি জানান, গভীর রাতে র‍্যাব সদস্যরা বাসা থেকে তাঁদের নামিয়ে নিয়ে আসেন। ঈদের কারণে ওই বাড়ির অনেক বাসিন্দাই এখনো আসেননি। আবদুল্লাহর পরিবারকে তাঁরা চেনেন। ওই ভবনেই তাঁদের আইপিএস তৈরির কারখানা রয়েছে। সেখানেই কবুতর পোষেন তাঁরা। এর জন্য তাঁদের একাধিক কর্মচারীও রয়েছে।

দুপুরে জোহরের নামাজের পর কয়েকজন মুসল্লি একসঙ্গে স্থানীয় মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলেন। তাঁরা বলেন, আবদুল্লাহর পরিবার এই এলাকায় অনেক বছর থেকে বাস করছে। তিনি নিয়মিত মসজিদে নামাজ পড়তেন। তবে তিনি জঙ্গি কি না, এ বিষয়ে কারও কোনো ধারণা নেই।

এদিকে জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা পুলিশের আরেকটি সংস্থা জানিয়েছে, তাদের কাছে মিরপুর এলাকার আবদুল্লাহ ওরফে কবুতর আবদুল্লাহ নামে পুরোনো জেএমবির এক সদস্যের তথ্য ছিল। ওই আবদুল্লাহ ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত জেএমবির বিভিন্ন পর্যায়ের পলাতক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। তবে ২০০৭-এর পর তাঁকে আর সক্রিয় দেখা যায়নি। তাঁরা ধারণা করছেন, এই আবদুল্লাহই সেই কবুতর আবদুল্লাহ।

 
 

আরও খবর

Daraz
 
 
©ambalanews24.com | Developed & Maintenance by AmbalaIT