শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪ ৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
Smoking
 
১১. মা - আনিসুল হক
প্রকাশ: ০৩:৪৪ pm ০২-০৮-২০১৭ হালনাগাদ: ০৩:৪৭ pm ০২-০৮-২০১৭
 
 
 


(১১)
আজাদ আইএ পড়ার জন্যে ভর্তি হয় সিদ্ধেশ্বরী কলেজে। কলেজে পড়ে, নাজ কিংবা গুলিস্তান হলে ছবি দেখে, বন্ধুদের সাঙ্গে আড্ডা দেয়। সে খুবই ভক্ত এলভিস প্রিসলির। ছোটবেলা থেকেই খুব কমিকস পড়ে। বড় হতে হতে সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ জন্মে। প্রচুর উপন্যাস পড়েছে, বাংলা উপন্যাস, ইংরেজি উপন্যাস। এর মধ্যে মিলস অ্যান্ড বুন থেকে শুরু করে পেঙ্গুইন ক্লাসিক্স। লরেন্স থেকে টলস্টয়-ডস্টয়ভস্কি পর্যন্ত। বঙ্কিম থেকে শরৎচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ।
সিনেমা দেখতে গেলে তার সঙ্গী হয় জায়েদ। অন্য বন্ধুরাও হয় কখনও কখনও। তবে তার আশ্চর্য লাগে বড়লোক বন্ধুদের। আজাদরা ফরাশগঞ্জের বাড়িতে চলে আসার পর তার অনেক বড়লোকের ছেলে বন্ধু তাকে এড়িয়ে চলে। যেন তার সঙ্গে মিশলে তাদের জাত চলে যাবে। আশ্চর্য তো।
জায়েদের মা নাই। তারা পাঁচ-পাঁচটা বাচ্চা এ বাড়িতেই থাকে। সাফিয়া বেগমকেই সব দেখাশোনা করতে হয়। তাদের খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনার খরচের ব্যাপার আছে। সাফিয়া বেগমকে একটু একটু করে গয়না ভাঙিয়ে টাকা-পয়সা জোগাড় করতে হয়।
এর মধ্যে আজাদ বাবার কাছ থেকে তার মাসোহারা পায়। মাসে মাসে টাকাটা ওঠাতে যায় জায়েদ। জায়েদও স্কুলে যায়। লেখাপড়া করে। তবে পড়াশোনার দিকে তার তেমন মনোযোগ নাই।
একদিনের ঘটনা। বাসায় চাল নাই। হঠাৎ রাতে চাল শেষ হয়ে গেছে। রাতের বেলা আজাদের আরেক খালা এসেছে, আরো অতিথি এসেছে। অতিরিক্ত রাঁধা হয়ে গেছে। সকালবেলা চাল কিনতে হবে। রেশনের দোকানে যেতে হবে। আজাদের মায়ের কাছে নগদ টাকা নাই। রেশনটা না তুললে আবার দোকান থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে। নাহলে দুপুরে আজকে হাঁড়ি উঠবে না চুলায়।
আজাদের মা বলেন, ‘জায়েদ, কী করি, বল তো!’
জায়েদ বলে, ‘আমার কাছে কিছু টাকা জমানো আছে। আমি রেশন নিয়া আসি। আপনি পরে দিয়েন আম্মা।’
‘তাহলে তাই কর।’
জায়েদের কিন্তু ভরসা আজাদ। আজাদের কাছে হাতখরচের টাকা থাকে। সেখান থেকে ধার নিতে হবে। তবে সেটা আম্মাকে জানানো যাবে না। চৌধুরীর টাকা শুনলে আম্মা সেই টাকায় কেনা অন্ন স্পর্শ করবেন না।
জায়েদ গিয়ে ধরে আজাদকে। ‘দাদা, কিছু টাকা ধার দ্যাও তো।’
‘কত ?’
‘দ্যাও না।’
‘কী করবি ? সিনেমা দেখবি ?’
‘না। বাজার সদাই করব।’
‘আচ্ছা চল। এক জায়গায় টাকা পাই। তুলে আনি।’
আজাদ আর জায়েদ বের হয়। আলী নামে এক লোকের কাছে আজাদের মাসোহারার টাকা থাকে। সেখান থেকে কিস্তিতে কিস্তিতে টাকাটা তোলা হয়। তবে এ মাসের শেষ কিস্তির টাকাটা আলী ঠিকমতো দেয়নি। জায়েদকে অযথা ঘোরাচ্ছে।
আলী বসেছিল গদিতে। আজাদকে দেখে তটস্থ হয়-’এই, চেয়ার দে। আরে মুছে দে। ভাইয়া বসেন। কী খাবেন ? চা আনাই। লেমনেড খাবেন ?’
‘টাকাটা দাও। যাইগা’-আজাদ দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলে।
১০০ টাকা পাওয়া যায়। তাই নিয়ে আজাদ আর জায়েদ বের হয়। সদরঘাট থেকে বাংলাবাজার। বটগাছটার নিচে একটা বড় বইয়ের দোকান। হিউবার্ট নামে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এটা চালান। আজাদকে দেখেই তিনি গুড মর্নিং বলে ওঠেন।
আজাদও গুড মর্নিং বলে সম্ভাষণের জবাব দেয়।
‘নয়া বই আসিয়াছে স্যার’-হিউবার্ট বলেন।
আজাদ বই দেখায় মগ্ন। কী সব ইংরেজি বই। জায়েদ বইগুলোতে কোনো মজা পায় না। সে খানিকক্ষণ হিউবার্টের দিকে তাকিয়ে থাকে। লোকটার গায়ের রঙ ফরসা, তবে চামড়ায় বুটি বুটি দাগ, ভুরুগুলো বড় বড় আর শাদা, চুলও শাদা, গায়ে কোট, পরনে প্যান্ট। লোকটা কথা বলছে হয় ইংরেজিতে, নয়তো বইয়ের বাংলায়। আর বটগাছ থেকে পাখির বর্জ্য পড়ছে টুপটাপ। জায়েদ লক্ষ্য করে, বটের ফল খেয়ে পাখিগুলো যা ত্যাগ করে, তাও আসলে ফল, তাই মাথায় পড়লেও কেউ ব্যাপারটা গায়ে মাখছে না, গায়ে লাগছেও না। জায়েদ এদিক-ওদিক তাকিয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, দাদা, যাইবা না, চলো।
আজাদ বই থেকে মুখ না তুলে বলে, ‘যা, তুই ওই হোটেলে মাটন কাটলেট ভাজছে, খেয়ে আয় যা। নে, টাকা নে।’
জায়েদ তো খুশিতে লাফাতে লাফাতে বাতাসের আগে আগে ছুটে যায়।
এদিকে আজাদ বইয়ের মধ্যে মজা পেয়ে গেছে। সে একটার পরে একটা বই নামাচ্ছে। একটা মোটা ছবিঅলা বই পেয়ে সে পাগলের মতো খুশি হয়। দেখেন তো এই কয়টার দাম কত হয় ?
দাম একশ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
‘আচ্ছা তাহলে এটা বাদ দ্যান। এখন দেখেন’-আজাদ একটা বই বাদ দিয়ে বাকিগুলো এগিয়ে দেয়।
‘ওয়ান হান্ড্রেড ফোর’-হিউবার্ট বলেন।
আজাদ পকেট হাতড়ে খুচরো বের করে দাম মিটিয়ে দেয়।
জায়েদ আসে।
আজাদ তার হাতে বইয়ের বোঝা ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘নে। যাইগা। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
তারা বাসায় ফেরে রিকশায়। জায়েদ বইগুলো দাদার ঘরে নামিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘টাকা দ্যাও।’
‘কিসের টাকা ?’
‘রেশন আনুম না ?’
‘ও। রেশনের টাকা। কত লাগে ?’
‘৫০ টাকা দ্যাও।’
‘অত টাকা তো এখন নাই।’
‘আরি এখনই না পাইলা!’
‘হাতে করে কী আনলি!’
‘বই।’
‘বই কিনতে টাকা লাগে না ?’
‘এত টাকার বই তুমি আনলা!’
‘তুই-ই তো বেটা বয়ে আনলি। দেখলি না কত ভারী।’
‘অহন। আইজকা রেশন না আনলে তো ল্যাপ্স হইয়া যাইব।’
‘আরে কিসের ল্যাপস হইব। কালকে আনিস।’
‘আজকা খাইবা কী! চাউল নাই।’
‘দোকান থেকে দুই সের চাউল কিনে আন। টেবিল ক্লথটার নিচে দ্যাখ খুচরা পয়সা আছে। ঝাড় ঝাড়। দেখলি। নে। আজকার দিনটা পার কর। কালকের চিন্তা কাল।’
খুচরা পয়সা একসঙ্গে করে কম টাকা হয় না। জায়েদ বলে, ‘চলব। কিন্তু তোমার মতন পাগল দেখি নাই। চাউল কেনার টাকা জোগাড় কইরা কেউ বই কিনে ?’
আজাদ হাসে। ‘আর তুই কী করেছিস। চাউল কেনার টাকা দিয়ে কাটলেট খেয়েছিস। ছি।’
জায়েদ লজ্জা পায়। সে দোকানের দিকে দৌড় ধরে। আজাদ হাসে। কিন্তু তার বুকের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বেদনাও যেন সুচের মতো ফুটছে। আজকে মাকে চাউল কেনার টাকার কথাও ভাবতে হচ্ছে। অথচ মায়ের নামে এই ফরাশগঞ্জের বাড়িটা, ওই ইস্কাটনের বাড়িটা। পৃথিবীটা কি একটা নাগরদোলা ? মানুষ আজ ওপরে তো কাল নিচে! নিয়তির হাতের পুতুল মাত্র! তাদের ম্যাট্রিকের বাংলা ব্যাকরণে একটা সমাস পড়তে হয়েছে। রাজভিখিরি। যিনি রাজা তিনিই ভিখিরি। বা রাজা হইয়াও যিনি ভিখিরি। তার মা কি তাই ? যিনিই রানী তিনিই ভিখিরিনী!
এইসব হতাশা থেকেই বোধকরি আজাদ সিগারেটটা মজবুত-মতো ধরে ফেলে। তবে সে খায় সবচেয়ে দামি সিগারেট, বিদেশী ব্রান্ডের সিগারেট। চৌধুরী সাহেবের রক্তের ধারা আর যাবে কোথায় ? আজাদ সিগারেট কেনার জন্যে স্টেডিয়ামে মোহামেডান ক্লাবের উল্টো দিকে রহমত মিয়ার বিখ্যাত দোকানে যায়, বিদেশী সিগারেট কেবল ওই দোকানেই পাওয়া যায় ঢাকায়। আড়াই টাকা দামের এক প্যাকেট সিগারেট কেনার জন্যে আড়াই টাকার ট্যাক্সিভাড়া দিতে তার কার্পণ্য নাই।
সিদ্ধেশ্বরী কলেজ থেকে আজাদ আইএ পরীক্ষা দেয়। সেকেন্ড ডিভিশনে পাসও করে। এবার সে পড়বে কোথায় ?
ঢাকার পরিস্থিতি বেশি সুবিধার নয়। ছাত্ররা নানা রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। তারা এখন তৎপর সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন নিয়ে। সারা দেশে হরতাল পালিত হচ্ছে। শোভাযাত্রা-সমাবেশ এসব তো আছেই। তার ওপর বছরের শুরুতেই ঢাকায় সংঘটিত হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আবার সংগঠিত হচ্ছে। তাদের স্মৃতি থেকে দু বছর আগে ১৭ সেপ্টেম্বরে শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে হরতাল, মিছিলে গুলি, টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ, একজনের শাহাদত বরণ-এসব মুছে যায়নি।
আজাদ একদিন আড্ডা দিতে গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। কাদের যেন কর্মসূচি ছিল সেদিন, ওরা জানত না। মিছিল হচ্ছে, হঠাৎই শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। পালাতে গিয়ে একটা ড্রেনের মধ্যে পড়ে পা মচকে যায় আজাদের। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে আসে বাসায়।
জায়েদ এসে বলে, ‘দাদা, পা টিপা দিমু।’
‘আরে না। মাথা খারাপ। তুলা দিয়ে নাড়লেও মরে যাব। উফ্, কী ব্যথা রে!’
‘দাদা, এক কাম করি, কাইলকা যাই ইস্কাটনে, চৌধুরী সাবরে কই দাদার পাও ভাইঙা গেছে, ট্রিটমেন্ট করান লাগব, মালপানি ছাড়েন।’
‘ভালো বুদ্ধি বের করেছিস তো। হ্যাঁ। কালকে যাবি।’
জায়েদ পরের দিন গিয়ে হাজির ইস্কাটনের বাসায়। দারোয়ান পথ আটকে দাঁড়ায়-’কই যাইবেন ?’
‘চৌধুরী সাবের লগে দেখা করুম’-জায়েদ বলে।
‘ক্যান ?’
‘ছোট সাবে পাঠাইছে। হের পা ভাইঙা গেছে। হেই খবর দিতে হইব।’
দারোয়ান গেইট ছাড়ে। ভেতরে গিয়ে সে দাঁড়ায় চৌধুরী সাহেবের কাছে।
‘সালামালেকুম খালু।’
‘ওয়ালাইকুম। ক্যান আইছ ?’
‘আজাদ দাদা পাঠাইছে। হের পাও ভাঙছে।’
‘পা ভেঙেছে। কী করে ভাঙল ?’
‘ইউনিভার্সিটিতে গেছল। গণ্ডগোল লাগছে। হে বেকায়দায় পইড়া পাও ভাইঙা ফেলাইছে।’
চৌধুরী সাহেবের ফরসা মুখটা সঙ্গে সঙ্গে লাল হয়ে যায়। কিছুক্ষণ ভেবে তিনি বলেন, ‘আজাদরে বলো এই বাসায় এসে থাকতে!’
‘কমুনে। আইব না। আপনেরে টাকা দিবার কইছে।’
চৌধুরী সাহেব ভেতরে যান। জায়েদ বৈঠকখানায় দাঁড়িয়েই থাকে। টমি এসে তার গা শোঁকে। পরিচিত গন্ধ পেয়ে লেজ নাড়ে। একটু পরে কদম আলী এসে হাত বাড়িয়ে দেয়। তার হাতে টাকা।
জায়েদ জিজ্ঞেস করে, ‘কত ?’
‘এক হাজার। গইনা লও।’
জায়েদ টাকাটা গোনে। তারপর খুশি মনে বেরিয়ে যায়। আজাদ দাদার কাছ থেকে আজ মোটা অঙ্কের ভেট আদায় করা যাবে। অন্তত চার দিন সিনেমা দেখা যাবে ডিসিতে।
রাত্রিবেলা ঢাকা ক্লাবে আবার ইউনুস চৌধুরীর প্রথম পত্নীর জন্যে শোক উথলে ওঠে। তিনি গেলাসের পরে গেলাস উজাড় করতে করতে সামনে বসা এআই খানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা বলেন তো, সাফিয়া বেগম কবে আমার পায়ের কাছে এসে পড়বে ?’
এআই খানের অবস্থাও তখন খারাপ। তিনি বলেন, ‘পায়ের কাছে কেন পড়বে ? হোয়াই অ্যাট দি ফিট। নো। ইউ হ্যাভ গট হার হেভেন আন্ডার ইয়োর ফিট। ইউ শুড নট অ্যালাউ হার এনটারিং ইন টু দি হেভেন সো ইজিলি।’
‘সে তো কিছুতেই আমার কাছে আসছে না। একটা মহিলার কেন এত তেজ ? কেন ? আমি কী দেইনি তাকে ? বাড়ি তার। ছেলে তার!’
এআই খান বুদ্ধি দেন, ‘শোনেন, তার ছেলেকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেন। সেন্ড হিম টু করাচি। মেক হার আইসোলেটেড। দেন শি উইল গিভ ইন। শি মাস্ট।’
এরই মধ্যে আজাদের মায়ের কোল থেকে দু বছর বয়সী জায়েদের ছোট্ট ভাই লিমনকে এক রকম প্রায় কেড়েই নিয়ে গেছেন জায়েদের বাবা। বাচ্চাটাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। সেই বাচ্চা মারা গেছে। সেই শোকে জায়েদ ও তার ভাইবোন আর আজাদের মা খুবই ভেঙে পড়েছে। একটা বাচ্চা যখন বাড়িতে থাকে, সে পুরোটা বাড়ি জুড়ে থাকে। এই বাড়িতেও লিমন ছিল সবার কোলজুড়ে। সে চলে যাওয়ার পরই সবার মন ছিল খারাপ। তার ওপর সে মারা গেছে, এই খবর শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। বাসার ঠিকে ঝিটা পর্যন্ত কেঁদে কেঁদে ওঠে, ‘বাচ্চাটারে এইখান থাইকা নিয়া গিয়াই মাইরা ফেলল। কেমন পাষাণ বাবা রে।’
আজাদকে ঢাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার বুদ্ধিটা চৌধুরী সাহেবের মাথায় খেলে যায়। আজাদকে ঢাকায় রাখা যাবে না। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়ার পরিবেশ নাই। সক্ষম লোকের ছেলেমেয়ে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে ? আজাদকে করাচি পাঠাতে হবে। তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে। ছেলেটার ভালো হবে। এই গণ্ডগোলের বাইরে থেকে সে ভালো করে লেখাপড়া করতে পারবে। তার জীবনের নিরাপত্তা থাকবে। আবার মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে আলাদা করা যাবে। তখন দেখা যাবে, মা কী করে একা ঢাকায় থাকে। এখন আমি আজাদকে যে মাসোহারা দেই, সেটা নিশ্চয়ই আজাদ তার মা আর তার খালাতো ভাইবোন পঙ্গপালের পেছনে ব্যয় করে। এটাও বন্ধ হবে। ছেলেকে করাচিতে যে খরচ পাঠাব, সেটা নিশ্চয় সে আর মায়ের পেছনে ব্যয় করতে পারবে না।
চৌধুরী সাহেব আজাদের এক মামাকে ফোন করে আনান। তাঁকে আজাদ ডাকে পাতলা মামা বলে। বিক্রমপুরে যেহেতু বেশির ভাগ বিয়েই আত্মীয়দের মধ্যে হতো, কাজেই পাতলা মামা আবার পাতলা চাচাও হয়। চৌধুরী সাহেব আজাদের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন এই পাতলা মামাকে।
পাতলা মামা হাজির হন ফরাশগঞ্জের বাসায়। দেখা করেন সাফিয়া বেগমের সঙ্গে। তাঁকে বলেন, ‘বুবু, ছেলে তো শুনছি আইএ পাস করছে। খুব খুশির খবর। আলহামদুলিল্লাহ। এবার ছেলেকে পড়াবা কই ?’
সাফিয়া বেগম বলেন, ‘আজাদ তো বলে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। সে তো সারা দিন ওই দিকে ঘুরঘুর করে।’
পাতলা মামা বলেন, ‘না না না না। এইখানে আজাদের থাকাটা ঠিক হবে না। বিশেষ করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়া একদম অনুচিত হবে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। আরো খারাপ হবে। ভদ্রলোকের ছেলেরা তো ঢাকায় পড়ে না।’
‘তাহলে তারা কই কই পড়ে ?’ আজাদের মার চোখেমুখে উদ্বেগ!
পাতলা মামা একটা পানের খিলি মুখে পুরে বুড়ো আঙুলে চুন লাগিয়ে সেটা নিজের জিভে লাগান। তারপর আঙুলে লেগে থাকা চুনের অবশিষ্টটা গোপনে টেবিলের নিচে মুছতে মুছতে বলেন, ‘করাচি। ভদ্রলোকের ছেলেরা পড়ে করাচিতে।’
সাফিয়া বেগমের মুখটা সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে পড়ে। এই কথা তাঁর প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ। করাচিতে ছেলেকে পাঠিয়ে তিনি একা একা কী করে থাকবেন! আর খরচই বা আসবে কোত্থেকে ?
পাতলা মামা বলে চলেন, ‘করাচিতে পড়ার খরচ যা লাগে, তা তো আজাদের বাবার কাছ থাইকাই আদায় করা যাবে। আপনি আজাদের বাবার কাছ থাইকা দূরে সইরা আসছেন, তাই বইলা তো বাবার ওপর থাইকা আজাদের হক চইলা যায় না। আর মাসের হাতখরচ অর বাবা অরে যা দেয়, তা একটু বাড়ায়া দিলেই তো আজাদের করাচির খরচ হইয়া যায়।’
আজাদের মা তাঁর ভাইয়ের এ প্রস্তাবটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। আসলেই এখানে থাকলে আজাদের লেখাপড়া হবে না। এমনিতে তার বন্ধুবান্ধব বেশি। তাদের সবার স্বভাব-চরিত্র যে এক রকম তা নয়। তার ওপর আবার দেশের যা পরিস্থিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগি্নগর্ভ হয়ে আছে। ছেলেকে করাচি পাঠানোই ভালো। তিনি বলেন, ‘পাঠাতে পারলে তো খারাপ হতো না। কিন্তু আমার পক্ষে কারো কাছে কোনো সাহায্য চাওয়া সম্ভব না।’
‘তাইলে আমি অ্যারেঞ্জ করি’-পাতলা মামা বলেন, ‘চৌধুরী এতে আপত্তি করবে বইলা মনে হয় না।’
পাতলা মামা আজাদের করাচি যাওয়ার সব ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করে ফেলেন।
রাত্রিবেলা। ফরাশগঞ্জের বাসার ডাইনিং টেবিলটা সেগুনকাঠের। অনেক বড়। তবে ওপরের রেঙ্েিনর টেবিল-ঢাকনিটা পুরনো হয়ে গেছে। একপাশটা সামান্য ছেঁড়া। আজাদের পাতে ভাত তুলে দিচ্ছেন মা। আজাদ ভাতের দলা ভাঙছে।
মা টেবিল-ঢাকনিটার ছেঁড়া অংশটায় নখ খুঁটতে খুঁটতে বলেন, ‘দুপুরে খেয়েছিস কই ?’
‘খেয়েছি। পপুলার হোটেলে।’
‘হোটেলে মোটেলে খেয়ে পেটে গ্যাস্ট্রিক বানাবি ?’ তিনি ছেলের পাতে শাক তুলে দিতে দিতে বলেন।
‘না। রোজ খাই না তো!’
‘লেবু দিয়ে শাক দিয়ে ভাতটা মেখে খা। শাকের মরিচটা একটু ডলে নে।’
‘ঝাল খেতে পারি না।’
‘তাহলে। হোটেলের লাল ঝোল খাস কেমন করে ?’
ছেলে খায়। মা তাকিয়ে তাকিয়ে তার খাওয়া দেখেন। টমেটো দিয়ে ধনে পাতা দিয়ে রুই মাছের ঝোল করেছেন। ছেলের পাতে তুলে দিতে দিতে বলেন, ‘শোন, তোর করাচি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি। তোকে ১০/১৫ দিনের মধ্যে রওনা হতে হবে।’
‘বলো কি তুমি! তোমাকে ছেড়ে আমি যেতে পারব না’-আজাদ বলে।
‘কয় কী পাগলে! তোকে যেতেই হবে। তুই ওখানে বিএ-এমএ পড়বি, ডিগ্রি নিবি, দেশে ফিরে এসে চাকরি করবি, নাহলে ব্যবসা করবি, তখন আমার মনে শান্তি আসবে। আমি বেঁচে আছি তো তোকে মানুষ দেখে যাব বলে। আরেকটু ভাত দেই ?’
‘কেন, এইখানে আর লোকের ছেলেমেয়ে পড়ছে না ?’
‘পড়ুক। লোকের কথা আর আমার কথা এক না। লোকের কি আর আমার মতন একটা মাত্র ছেলে ? আর কেউ নাই! জামাই নাই। ভাই নাই। বাপ নাই। মা নাই!’
‘সেই জন্যেই তো আমি যেতে চাই না।’
‘সেই জন্যেই তোকে তাড়াতাড়ি পাঠাতে চাই। এইখানে ইউনিভার্সিটি গিয়ে কেমন পা ভেঙে এসেছিস। আর না। ভাত খাওয়ার মধ্যে আবার পানি খাস কেন ? খাওয়া শেষ করে খা।’
মায়ের জেদের কাছে পরাভব মানতে হয় আজাদকে।
পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের টিকেট তার জন্যে কেনা হয়।
দাদা চলে যাচ্ছে। জায়েদের খুব মন খারাপ। সে আজ আর স্কুলে যাবে না। সে দাদার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। আম্মা সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার সময় জায়েদের কোনো তৎপরতা না দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘কিরে, তুই ঢিলা মেরে বসে আছিস কেন ? স্কুল তো লেট হয়ে যাবি।’
‘স্কুল যামু না।’ জায়েদ বলে।
‘কেন, যাবি না কেন ?’
‘দাদার লগে লগে থাকুম।’
‘দাদা কি সকালে যাচ্ছে নাকি! তুই স্কুল থেকে এসেও তো দাদার সঙ্গে থাকতে পারবি! যা, স্কুল যা।’
‘দাদা আমারে যাইতে নিষেধ করছে।’
করাচি যাওয়ার জন্যে দাদা ব্যাগ গোছাচ্ছে। জায়েদ তাকে জিনিসপত্র এগিয়ে দিতে থাকে। কাপড়-চোপড়। শেভিং ক্রিম, ব্রাশ, সেফটি রেজর। বইপত্র। এলভিস প্রিসলির রেকর্ডটা। জায়েদ বলে, ‘রেকর্ড লইয়া কী করবা দাদা ? প্লেয়ার পাইবা কই ?’
‘করাচি কি গ্রাম নাকি ?’ আজাদ জবাব দেয়।
‘নাজে তো ভালো সিনেমা আসতেছে। দেখবার পারবা না।’
‘করাচিতেও সিনেমা হল আছে।’
‘থাকুক। বাংলা বই তো আর চলব না। সুচিত্রা-উত্তমের বই কই দেখবা ?’
‘ওইখানেও নিশ্চয় চলবে। নাইলে আর কী! তুই দেখিস।’
‘ক্যামনে দেখুম। পয়সা দিব কে ?’
‘তোকে মাসে মাসে আমি সিনেমা দেখার টাকা পাঠিয়ে দেব। এই শোন, তোর কলম লাগবে ? ধর।’
আজাদ তার ড্রয়ারে রাখা কতগুলো কলম মুঠো করে জায়েদকে দেয়। জায়েদ ‘না লাগব না’ বলে নেয়। ড্রয়ারে আরো কতগুলো মূল্যবান সম্পদ আছে। একটা চাকু, এটা দিয়ে আম কাটা যাবে, একটা ঘড়ি, দাদা এটা পরে না, চাবিও দেয় না বহুদিন, আরো না জানি কত কিছু।
‘কিরে, ড্যাবড্যাব করে কী দেখিস ?’ আজাদ বলে।
‘ঘড়িটা নষ্ট নাকি! চাবি দ্যাও না কদ্দিন। আমার কাছে রাইখা যাও। ডেলি চাবি দিমুনে। ভালো থাকব।’
‘তোকে দিলে বেচে দিয়ে সিনেমা দেখবি।’
‘এত দামি ঘড়ি। মাথা খারাপ, নাকি পেট খারাপ ?’
‘তাইলে যা এটা তোকে দিয়ে দিলাম।’
‘চাকুটা কী করবা ? ধার দেওন লাগব না!’
‘এটা দিলে তোর দশ আঙুল কেটে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। এইটা দেওয়া যাবে না।’
দুটো প্লেবয় আছে। এগুলো ড্রয়ারে চাবি দিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে। নাহলে জায়েদের হাতে পড়ে গেলে মুশকিল।
‘জায়েদ যা, ঘর ছাড়।’
‘ক্যান। তোমার লগে থাকুম বইলা স্কুল গেলাম না। আর আমারে তুমি বাইর কইরা দ্যাও।’
‘আরে হতভাগা। বের করে দিচ্ছি নাকি। দুইটা মিনিট একটু ঘরের বাইরে যা না। দুইটা মিনিট।’
মা এক সময় রাঁধতে ভালোবাসতেন। এখনও বাসেন হয়তো। কিন্তু সামর্থ্য তো নাই। রান্না করতে হলে বাজার করতে হয়। কে বাজার করবে ? টাকা আসবে কোত্থেকে ? কিন্তু আজকে মা অনেক কিছু রাঁধতে বসে গেছেন। ছেলে তাঁর যা কিছু খেতে ভালোবাসে, তার সব। পোলাওয়ের চেয়ে তার শাদা ভাত পছন্দ বেশি। ইলিশ মাছ সর্ষে দিয়ে। পাবদা মাছের ঝোল। চিংড়ির মালাইকারি। গোরুর মাংস ভুনা। মুরগির দোপেঁয়াজা। একটু আলুভর্তা। দুটো বেগুন ভাজি। মসুরের ডাল। আহা, ছেলে আজ তাঁর দূরে চলে যাচ্ছে। এটা তো শুধু পড়তে কয়েক মাস কি কয়েক দিনের জন্যে চলে যাওয়া নয়, এ হলো জীবন থেকেই চলে যাওয়া। বিদেশে ছেলে যাবে পড়তেই বটে, কিন্তু বিএ এমএ পাস করে সে কি আর ফিরে আসবে, কার ছেলেই বা ফিরে আসে, ফিরে এলেও সে কি আর আগের ছেলে থাকে, অন্য রকম হয়ে ফেরে, তার মাথার মধ্যে তখন অন্য আকাশ, অন্য জগৎ, সে কি আর মায়ের বুকে ফিরে আসে ? মাকে জড়িয়ে ধরে ? জ্বর হলে মা মা বলে বিলাপ করে ? মাথার চুলে মায়ের আঙুলের বিলির জন্যে কাতর হয়ে পড়ে ? ছেলের সঙ্গে মায়ের তখন অপার ফারাক, দুজনের দুই জগৎ, ছেলে তখন অচেনা, তাকে ডাকে বাইরের জগৎ, সে তখন কাজের মানুষ, আর তার যেটুকু ভালোবাসা, যেটুকু স্নেহ, তা থাকে অন্যের জন্যে, অন্য নারী, অন্য কাজ, অন্য দরজা, অন্য আকাশের জন্যে। মায়ের চোখ ভিজে আসতে চায়, কারণ তিনি পেঁয়াজ কাটছেন, এ ছাড়া আর কিছু নয়। আর কোনো কারণ থাকতে পারে না।
‘মা, আমি একটু বাইরে গেলাম’-আজাদ বলে।
‘আবার কই যাস ? দুপুরে বাসায় খাস বাবা।’
‘আচ্ছা।’
‘আচ্ছা না। তোর জন্যে আমি রাঁধতে বসেছি। অবশ্যই খাবি।’
‘কী কী রাঁধছ ?’
‘খেতে বসলেই দেখতে পাবি।’
‘আচ্ছা আসব ‘খন।’
দুপুর গড়িয়ে যায়। আজাদ ফেরে না। মায়ের মন খারাপ। জায়েদ মাতৃহারা গোবৎসের মতো বাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। তার বাঁ হাতে ঘড়ি। ঘড়িটা চলছে। কানের কাছে নিয়ে সে টিক টিক শব্দ শোনে।
আজাদ ফেরে বিকালে। ‘মা, খিদা লেগেছে। খাবার দাও।’
‘দেওয়াই আছে। আয়। বস। হাত ধুয়ে আয়’-মা বলেন।
‘তুমি খেয়েছ ?’
‘আমার খাওয়া। আমি এইসব খাই ?’
‘না খেলে। ভাত তো খাও। এত বেলা না খেয়ে আছ। নাও। তুমিও নাও। জায়েদ খেয়েছে ? ডালু খেয়েছে ?’
‘হ্যাঁ। ওদের খাইয়ে দিয়েছি।’
‘ভালো করেছ। জায়েদ, এই জায়েদ, আয় বস।’ আজাদ উচ্চৈঃস্বরে বলে।
জায়েদ আসে। ‘আমি খাইছি। প্যাট ফুইলা আছে।’
‘আরে আবার বস। নে। বস। যা হাত ধুয়ে আয়। জলদি। জলদি।’ জায়েদ ‘না’ করতে পারে না। সত্যি তার পেটে কোনো জায়গা নাই। তবু দাদার পাশে বসার এ সুযোগ। আরেকটু কাছে থাকার সুযোগ! সে কি ছাড়তে পারে ? সে বসে পড়ে।
মা আজাদের পাতে ভাত তুলে দেন। আজাদ অন্যমনস্ক। সে থালার ভাত এক কোণে পালা করে। মা পাতে লেবু তুলে দিলে সে লেবু চিপতে থাকে। রস বেরিয়ে তার চোখে যায়। সে বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ডলে। মা প্লেটে আলুভর্তা তুলে দেন। সে ভালো করে না মেখেই গাপুসগুপুস করে ভাত মুখে তোলে।
মা বলেন, ‘আস্তে আস্তে খাও বাবা। ভালো করে মেখে খাও। কোথায় থাকবে না থাকবে, কী খাবে না খাবে, ভাত তো পাবেই না, রুটি পাবে।’
আজাদ মুখ তুলে মায়ের মুখে দিকে তাকায়। ‘আরে না। ভাত পাওয়া যাবে।’
জায়েদ বলে, ‘করাচিতে নাকি খুব ভালো কাবাব হয়। আস্ত খাসি আগুনে পুড়ায়া কাবাব বানায়। দাদা আরাম কইরা খাইতে পারব।’
আজাদ হাসে। ‘খাসির ভুঁড়ি কি বের করে নেয়, না পেটের ভিতরেই থাকে!’
মা বলেন, ‘আজাদ। শোনো। মনে রেখো, তুমি করাচি যাচ্ছ পড়তে। পড়াশোনাটা ঠিকমতো করবে। কষ্ট হলেও পড়াশোনাটা শেষ করবে। বিদেশে নানা কষ্ট হয়। কিন্তু পড়তে গেলে কষ্ট করতেই হবে। মনটা উতলা করবে না। ধ্যান ধরে পড়বে। আমাদের জন্যে চিন্তা করবে না। আমরা আল্লাহর ইচ্ছায় ভালো থাকব। চিঠি লিখবে।’
আজাদ বলে, ‘মা শোনো। তোমাকে একটা কথা বলি। আমি করাচি যেতে রাজি হয়েছি কেন জানো ? রেজাল্ট ভালো করার জন্য। এখানে তো বন্ধুবান্ধব বেশি হয়ে গেছে। ওখানে তো আর কেউ থাকবে না। খেলা নাই, আড্ডা নাই। খালি পড়া। দেখো, আমি যদি ফার্স্ট ক্লাস না পেয়েছি…’
‘খাও বাবা। খাও।’ মা একটা মুরগির রান তুলে দেন ছেলের পাতে।
সন্ধ্যার পরে রুমী আসে। সৈয়দ আশরাফুল হক আসে। ফারুক আসে। ইব্রাহিম সাবের আসে। তারা তিনতলায় আজাদের ঘরে বসে গল্পগুজব করে। হাসিঠাট্টা আমোদে মেতে ওঠে। ফারুক বলে, ‘দোস্তো, পাকিস্তানি মেয়ে পাইলে প্রথমে গায়ে পানি ছিটাইবা। যদি দেখো ঝাইড়া দৌড় দিতাছে, তাইলে যাইতে দিও। পিছনে পিছনে দৌড়াইও না। আর যদি দেখো পানি সহ্য করতে পারে, তাইলে কাছে যাইও। নাইলে বুঝলা না, এক মাস গোসল করে না, গায়ে গন্ধ করব।’
বন্ধুরা সবাই রাতে এখানে ভাত খায়। আজাদের মা অনেকদিন পরে তাঁর বাসায় বাইরের লোকদের আপ্যায়ন করেন। অথচ আগে প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। রাতের বেলা আবার তিনি ইলিশ-পোলাও রেঁধেছেন। এই পদ রান্নার জন্যে তাঁর খ্যাতি বিশেষজ্ঞ-পর্যায়ের। ইস্কাটনের বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পরে সেটা আর করা হয় না।
জায়েদ কিন্তু এত লোকের উপস্থিতি পছন্দ করছে না। একটু পরে দাদা চলে যাবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে, এখন কি সে দাদাকে একটু একা পেতে পারত না!
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মা বলে, ‘বাবা, রাত কোরো না, দিনকাল ভালো না, বিসমিল্লাহ করে বের হয়ে যাও। তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে গিয়ে বসে থাকতে তো অসুবিধা নাই।’
মা সব সময় আজাদকে ‘তুই’ করে বলেন। কিন্তু এখন বলছেন তুমি তুমি করে। মা বাইরে যতই শক্ত ভাব দেখানোর চেষ্টা করুন না কেন, ভেতরে ভেতরে তিনি বিদায়-ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েছেন।
আজাদ বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে বন্ধুরা। মা, জায়েদ, চঞ্চল, টিসুকে কোলে নিয়ে মহুয়া-এরাও আসে রাস্তায়। আরেক খালাতো ভাই ডালু আসে। তার হাতে আজাদের সুটকেস।
একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। আজাদের বন্ধু ফারুকের গাড়ি।
মা বলেন, ‘ঠিক আছে বাবা, আসো। দেখেশুনে যাও। টিকেট ঠিকমতো রেখেছ তো ?’
‘জি রেখেছি’-আজাদ বলে।
‘আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা দাও।’
আজাদ মাকে কদমবুসি করে। মায়ের বুকের ভেতর থেকে কান্না উগরে আসতে চাইছে। চোখের পানি বাঁধ মানতে চাইছে না। কিন্তু তিনি বাইরে থেকে তার কিছুই বুঝতে দেন না। মুখটা হাসি হাসি করে রাখেন। তাঁকে দেখলে বোঝার উপায় নাই যে ভেতরে তাঁর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আজাদ মায়ের ‘তুমি’ বলা শুনেই সব বুঝছে।
আজাদ গাড়িতে ওঠে। তার বন্ধুদেরও কেউ কেউ। গাড়ির হেডলাইট জ্বলে ওঠে। শব্দ করে স্টার্ট নেয় গাড়িটা। একটু একটু করে এগোতে থাকে। তারপর পেছনের লাল লাইট দেখিয়ে এক সময় সেটা অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন ঝপ করে এই জায়গাটায় একটা নিস্তব্ধতা এসে ভর করে। ডালু কোনো কথা বলে না, জায়েদ কোনো কথা বলে না, চঞ্চল কোনো কথা বলে না, টিসু না, বোনেরা না, মা না। তারা ঘরের ভেতরেও যায় না। আবার রাস্তার দিকে তাকিয়েও থাকে না। কয়েকটা মুহূর্ত শুধু, কিন্তু সে মুহূর্ত কয়েকটাই অনন্তকালের মতো সরণিজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘আল্লাহ মাবুদ’-আজাদের মায়ের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যাওয়ার পরে সবাই ঘরে ফিরে আসে।
গাড়িটা বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর, একটা রুমাল বের করে আজাদ চোখ মোছে।

 
 

আরও খবর

Daraz
 
 
 
 
 
 
 
 
©ambalanews24.com | Developed & Maintenance by AmbalaIT