শনিবার, ১৮ মে ২০২৪ ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
Smoking
 
রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের আয় কমে গেছে
প্রকাশ: ১০:৫০ am ২০-০৭-২০১৭ হালনাগাদ: ১০:৫৩ am ২০-০৭-২০১৭
 
 
 


গত দুই অর্থবছর দেশে একরকম শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে। নেই হরতাল-অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর কিংবা জ্বালাও-পোড়াও পরিস্থিতি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কয়েকটি জেলায় বন্যা ছাড়া ছিল না তেমন বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগও। শিল্পকারখানায় গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট থাকলেও উত্পাদন একেবারে থেমে থাকেনি। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয় এমন কোনো পরিস্থিতি ছিল না দেশে। তবুও দেশের অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করছে। অর্থনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী নেতারা অর্থনীতিতে এই মন্দার প্রধান কারণ হিসেবে আস্থা সঙ্কটকে দায়ী করছেন। দেখা যাচ্ছে অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর প্রবৃদ্ধিতে নিম্নগতি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতিবাচক। গত দেড় দশকের মধ্যে সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৬-১৭) রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১.৬৯ শতাংশ। শুধু তাই নয়, গত বছরের রফতানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তার চেয়ে আয় কম হয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ বা দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের আয় কমে যাওয়া। বিদায় বছরে ওভেন পোশাকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ১১.২১ শতাংশ এবং নিটওয়্যারে কমেছে ২.৯১ শতাংশ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উত্স রেমিট্যান্স। সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ সাড়ে ১৪ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে ব্যাপক হারে বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। অর্থবছরের প্রথম ১১ মাস শেষে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার। বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে যেসব লক্ষ্য ধরা হয়েছিল সেগুলোর অনেক কিছুই পূরণ হয়নি। দেশের সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর  বলেন, স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি খুব ভালো রয়েছে। দেশে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই, হরতাল নেই, এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন বড় কোনো কর্মসূচিও নেই। এ অবস্থায় তো দেশের অর্থনীতির সব সূচকই ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা সে রকমটি নয়। অনুকূল পরিবেশ থাকার পরও অর্থনীতির অনেক সূচকই মন্দা। এর পেছনে প্রধান কারণ আস্থাহীনতা। তিনি বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেও সবার মনে একটা আশঙ্কা কাজ করে, কখন কী হয়ে যায়। তাছাড়া সামনে নির্বাচন, আগামী বছরটিতে রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন হয় বা আগামীতে ক্ষমতায় আসে কারা-এ রকম নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে হচ্ছে দেশের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের। এ কারণে বিগত কয়েক বছর দেশে আশানুরূপ বিনিয়োগ হয়নি। আর নতুন বিনিয়োগ না হওয়াতেই দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে সেভাবে গতি আসেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ঘিরে টানা তিন বছর দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নাজুক ছিল। রফতানি বাণিজ্য চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পের বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শুরু থেকেই। গত দুই অর্থবছর অর্থাত্ ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে এক রকম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। অর্থনীতি বিনাশী তেমন কোনো কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। এই সময়ে দেশের অর্থনীতির সব সূচকও ভালো থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, অর্থনীতির অনেক সূচকই ভালো নেই। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রফতানি বাণিজ্য। পরিস্থিতি ভালো থাকলে রফতানিতেও ভালো প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা। কিন্তু সে রকমটি হয়নি। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানিতে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তা বিগত দেড় দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। সর্বশেষ ২০০১-০২ অর্থবছরে রফতানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর বিদায়ী বছরে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও সেটি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ। মাঝের কয়েকটি বছরে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত। ইপিবির তথ্যে জানা যায়, বিদায়ী বছর জুড়েই তৈরি পোশাক রফতানিতে আশানুরূপ রফতানি আয় অর্জন করা যায়নি। ধারাবাহিকভাবে উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। এই উদ্বেগের মধ্যেই সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে পোশাক রফতানিতেও প্রবৃদ্ধি কমে গত ১৫ বছরের সর্বনিম্ন হারে এসে ঠেকেছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকের ওভেনের আয় গত অর্থবছরের তুলনায় ২ দশমিক ২৫ শতাংশ কমেছে। নিটের আয় কিছুটা বেশি অর্থাত্ ৩ শতাংশ বাড়ার সুবাদে গড়ে তৈরি পোশাক রফতানি গত বছরের তুলনায় কম হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। আয় বেড়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। এ সময় পোশাক রফতানি থেকে আয় এসেছে দুই হাজার ৮১৪ কোটি ৯৮ লাখ ডলার, তা প্রত্যাশার চেয়ে বেশ কম। এ বিষয়ে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহসভাপতি ফারুক হাসান সকালের খবরকে বলেন, এ খাতে আন্তর্জাতিক বাজারের দরপতনসহ সংস্কারের কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া টাকার বিপরীতে ডলারের দাম কমায় প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে এ খাত সক্ষমতা হারাচ্ছে। কারখানার সংস্কার কাজের জন্য উত্পাদন ব্যয় বেড়েছে। তা ছাড়া কারখানাগুলোতে চাহিদা মাফিক গ্যাস ও বিদ্যুত্ মেলেনি সব সময়। মূলত এসব কারণেই পোশাক রফতানিতে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায়নি। অর্থনীতির আরেক চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স। কিন্তু এ খাতেও চরম মন্দা চলছে। সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, গত অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ সাড়ে ১৪ শতাংশ কমেছে। বিদায়ী অর্থবছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন। যা গত পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। রফতানি আয়ে ধীরগতি ও প্রবাসী আয় ব্যাপকহারে কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে চলতি হিসাবে ২১০ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঘাটতি হয়েছে। অর্থবছরের ১০ মাসের হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৭৬ কোটি ডলারের মতো। অথচ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ১১ মাসে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ৩১৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান সকালের খবরকে বলেন, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো লক্ষণ নয়। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স কমার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে বৈধ ব্যাংকিং চানেলের বাইরে ভিন্ন পন্থায় বৈদেশকি মুদ্রা পাঠানো। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকাকে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা আগামীতে এই সংস্কৃতি আরও বেড়ে যাবে, যা অর্থনীতির জন্য হবে আরও ক্ষতিকর। সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী ৮ শতাংশ জিডিপির (মোট দেশজ উত্পাদন) প্রবৃদ্ধি অর্জনে ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে জিডিপিতে ২৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ বিনিয়োগ বিদ্যমান। তাই স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বরাবরই হা-হুতাশা রয়েছে। বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করায় দেশের ব্যাংক খাতে অলস টাকার পাহাড় জমছে। ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য অর্থাত্ বিনিয়োগযোগ্য অর্থের পরিমাণ ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় নয় বছর ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) ২১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বর্তমানে সেই বিনিয়োগ মাত্র দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়েছে। অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে হলে আগামীতে টানা ২৬ বছর ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। এটি দেশের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন সকালের খবরকে বলেন, বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাটানো যাচ্ছে না। ফলে হাতে টাকা থাকার পরও বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগে কেউ এগিয়ে আসছে না। উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের আগে পুঁজির নিশ্চয়তা চান। কিন্তু তা না পাওয়ায় পুঁজি হারানোর ঝুঁকি নিতে চান না। ফলে বিনিয়োগ হচ্ছে না। যার প্রভাবে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য বাড়ছে। এজন্য সরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ১০ বছরে ব্যাংক খাত থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা বাইরে পাচার হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো বর্তমানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে এক ধরনের শ্লথগতি বিরাজ করছে। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে জমছে অলস অর্থ। আবার বিতরণকৃত ঋণ সঠিক সময়ে ফিরে না আসায় এবং সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে ঋণ দিতে না পারায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের বোঝা বেড়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

 
 

আরও খবর

Daraz
 
 
 
 
 
 
 
 
©ambalanews24.com | Developed & Maintenance by AmbalaIT