সেনউইজ পার্ক। এই মাঠের ইতিহাসে টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র একটি। ২০০২ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট ভেন্যু হিসেবে যাত্রা শুরু হয় পচেফস্ট্রমের এই মাঠটির। অর্থ্যাৎ যাত্রা শুরুর পর গত ১৫ বছরে এই মাঠে আর কোনো টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়নি। কিংবা টেস্ট ম্যাচের জন্য ভেন্যু হিসেবে নির্ধারণ করা হয়নি।
যদিও ২০০০ সালে ওয়ানডে ভেন্যু হিসেবে যাত্রা শুরুর পর এখানে মাঝে মধ্যে কিছু ম্যাচ আয়োজন হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড সিএসএ'র কাছে মাঠটি র্যাংকিংয়ে কতটা পিছিয়ে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে এই মাঠে কাদের নিয়ে সিরিজ আয়োজন করা হয় সে চিত্র দেখলে। ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি ম্যাচ বাদ দিলে ২০০২ সালের মার্চের পর এই মাঠে প্রোটিয়াদের প্রতিপক্ষ হচ্ছে নেদারল্যান্ডস, নামিবিয়া, কেনিয়া, বাংলাদেশ। বড়জোর জিম্বাবুয়ে।
প্রোটিয়াদের বিপক্ষে যে দুটি টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ, এর মধ্যে বাকিটির ভেন্যু ব্লুমফন্টেইনের মাঙ্গুয়াঙ ওভাল। সাকুল্যে এই মাঠে টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে ৪টি। এর মধ্যে ২০০৮ সালে সর্বশেষ এই মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষেই কোনো টেস্ট খেলেছিল স্বাগতিকরা। এরপর ৯ বছর পার হয়ে গেলেও মাঙ্গুয়াঙ ওভালে পাঁচদিনের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে প্রায়ই ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি সব বড় বড় দলকেই এই ম্যাচে খেলিয়েছে সিএসএ।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশ খেলবে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজও। এই তিন ওয়ানডের তিনটি ভেন্যু হচ্ছে কিম্বার্লির ডি বিয়ারস ডায়মন্ড ওভাল, পার্লের বোল্যান্ড পার্ক এবং ইস্ট লন্ডনের বাফেলো পার্ক।
ইস্ট লন্ডনের বাফেলো পার্ক স্টেডিয়ামে একটি মাত্র টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেটাও বাংলাদেশের বিপক্ষে। ২০০২ সালে। এরপর এই মাঠে কোনো টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়নি। ওয়ানডে ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয় কদাচিৎ, মাঝে-মধ্যে। সর্বশেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হয়েছে ২ বছর আগে, ২০১৫ সালে। এর আগে ২০১২ সালে একটি, ২০০৮ সালে একটি। ১৯৯২ সালে ওয়ানডে ভেন্যু হিসেবে যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে দিয়ে কিছু ওয়ানডে ম্যাচ এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কিম্বার্লির ডি বিয়ারস ডায়মন্ড ওভাল স্টেডিয়ামে কোনো টেস্ট খেলা হয়নি। সর্বশেষ ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৩ সালে। অথ্যাৎ ৪ বছর এই মাঠে কোনো ওয়ানডে ম্যাচ হয় না। ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরুর পর মাত্র ১১টি ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে এখানে।
পার্লের বোল্যান্ড পার্ক স্টেডিয়ামেরও একই অবস্থা। ২০১৩ সালে সর্বশেষ কোনো ওয়ানডে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই মাঠে। ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরুর পর মাত্র ১০টি ওয়ানডের সাক্ষী হলো এই মাঠের দর্শকরা। সিরিজের বাকি দুই টি-টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে দুই টেস্ট ভেন্যু সেনউইজ পার্ক এবং মাঙ্গুয়াঙ ওভালে।
অথচ, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে কোনো দল গেলে তারা যে সব ভেন্যু নির্ধারণ করে সে সব ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে খুব পরিচিত। জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম, কেপ টাউনের নিউল্যান্ডস, পোর্ট এলিজাবেথের সেন্ট জর্জ পার্ক, সেঞ্চুরিয়নের সুপার স্পোর্টস পার্ক কিংবা ডারবানের কিংসমিড। দক্ষিণ আফ্রিকায় এসবই নামকরা স্টেডিয়াম। প্রচুর দর্শক হয়। মাঠের সুনাম রয়েছে চারদিকে। নিয়মিত খেলা হওয়ার কারণে এসব মাঠের পরিচর্যাও হয় নিয়মিত।
অথচ, ২০০৮ সালে সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার এবারও বাংলাদেশের সঙ্গে ৯ বছর আগের সেই আচরণই করছে ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা (সিএসএ)। বাংলাদেশ তো আর সেই ৯ বছর আগে পড়ে রয়নি। মাঠে নেমে অন্তত ভালো ক্রিকেট খেলতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারে। প্রতিক্ষের মাথার ঘাম, কপালের ঘাম পায়ে ফেলতে পারে। কখনও-সখনও জয় তুলে নেয়। ঘরের মাঠে তো অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডকে টেস্টে পরাজিত করেছে টাইগাররা। খোদ দক্ষিণ আফ্রিকাকেই ওয়ানডে সিরিজে হারিয়েছে বাংলাদেশ।
তাহলে কেন একেবারে অব্যবহৃত, অপিরিচিত মাঠকে বাংলাদেশের সিরিজের জন্য ভেন্যু নির্ধারণ করলো দক্ষিণ আফ্রিকা! যে মাঠে দীর্ঘদিন খেলা হয় না, টেস্ট অনুষ্ঠিত হয় না- সেই মাঠের উইকেট হঠাৎ খেলতে গেলে কিরূপ আচরণ করবে সেটাও তো একটা বিরাট চিন্তার বিষয়। পরিচিত মাঠ হলে এগুলোর অতীত ইতিহাস-পরিসংখ্যান ঘেঁটে পরিকল্পনা সাজানো যায়। মাঠ সম্পর্কে একটা পূর্ব ধারণা থাকে।
কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিচিত, কম ব্যবহৃত মাঠকে ভেন্যু হিসেবে নির্ধারণ করার কারণে বাংলাদেশ মাঠ সম্পর্কে আগাম ধারণা নেয়া থেকে বঞ্চিত হবে। এসব মাঠের গতি-প্রকৃতি কেমন সেটা জানা হবে না। পরিকল্পনাও সাজানো যাবে না ঠিক মত। সুতরাং, মাঠে নামার পর যে কোনো বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে টিম বাংলাদেশ।
অথচ নিয়ামানুসারে ভেন্যু নির্ধারণের বিষয়টি স্বাগতিক দেশের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে সফরকারী দেশকে জানানো হয় অনুমোদন দেয়ার জন্য। এ ক্ষেত্রে অনুরোধ কিংবা আপত্তির সুযোগও থাকে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে তেমন কোনো আপত্তিই তোলা হয়নি। বিসিবি ভেন্যু নির্ধারণ কিংবা ওই সব ভেন্যু সম্পর্কে না জেনেই হয়তো অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। তারা ভেন্যুর ইতিহাস, পরিসংখ্যান সম্পর্কেই হয়তো জানতো না।
এসব নিয়ে যার উত্তর দেয়ার কথা সেই বিসিবি পরিচালক এবং ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান আকরাম খানের কথা শুনে অন্তত তেমনটাই মনে হওয়ার কথা। তিনি বলেন, 'টেস্ট না হলেও এসব ভেন্যুতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট নিয়মিতই হয়েছে বা হচ্ছে। এবং এগুলো তো প্রতিষ্ঠিত ভেন্যু। শুধু আমরা নই, কোনো অতিথি দল নির্দিষ্ট কোনো ভেন্যুতে খেলার কথা জোর দিয়ে বলতে পারে না। কিংবা খেলার দাবি করতে পারে না। তবে পছন্দের কথা জানানো যায়। ভেন্যু নির্ধারণ শেষ পর্যন্ত স্বাগতিক বোর্ডের ওপরই।'
তাহলে সফরকারী দেশের পক্ষে কোনো কিছুই দেখার নেই? জবাবে আকরাম খান বলেন, 'আমরা দেখি আবাসন সুযোগ সুবিধা, প্র্যাকটিস প্যাসিলিটিজ ঠিক আছে কি না। পাঁচ তারকা হোটেল, ছিমছাম সুন্দর পরিবশে, আউট ডোর ও ইনডোর প্র্যাকটিস সুবিধা- এগুলোর পাশাপাশি একটা টেস্ট ভেন্যু যেমন হওয়া উচিৎ, তা আছে কি না সেটাই শুধুমাত্র আমরা লক্ষ্য করি।'
আকরাম খানের কথায় একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, নির্ধারিত ভেন্যুগুলোতে যে এতদিন খেলা হয় না, হয়তো বা বিসিবি এগুলো লক্ষ্যই করেনি। কিংবা জানতোই না। তারা টেস্ট ভেন্যুর চেয়ে আবাসন ও প্র্যাকটিস সুযোগ-সুবিধা নিয়েই বেশি মাথা ঘামিয়েছেন। ভেন্যু কেমন, সেটা চিন্তাই করেননি।