প্রবাসী আয় অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবণতা চলছে, যা অর্থনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত। এমতাবস্থায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাংকের ফি কমানোর ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ২০ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে গতকাল বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নির্বাহী পরিচালক আহমেদ জামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কর্মকর্তাদের কাছে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর উপায় বের করার পরামর্শ চাওয়া হয়। তবে রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাংকের চার্জ যত্সামান্য থাকায় ফি কমানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তাছাড়া ব্যাংকের বাইরে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন বা মানিগ্রামের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে যে চার্জ নেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও কিছু করার নেই বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। গতকাল সভায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখানো হয়েছে, ২০১৬ সালে আসা মোট প্রবাসী আয়ে ৪৯ দশমিক ২৮ শতাংশ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে এসেছে। বাকি ৫০ দশমিক ৭২ শতাংশ প্রবাসী আয় এসেছে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। অর্থাত্ প্রায় অর্ধেক পরিমাণ প্রবাসী আয় ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে এসেছে। এই হার ২০১৩ সালে ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। ওই বছরে প্রবাসী আয়ের ৬৭ দশমিক ৩২ শতাংশ ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছিল, আর বাকি ৩২ দশমিক ৬৮ শতাংশ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে এসেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৯১৯ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে আসে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম। অথচ ২০১২-১৩ অর্থবছরেও ১ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল। ওই অর্থবছরের পর শুধু ২০১৪-১৫ অর্থবছর ব্যতীত সব অর্থবছরেই রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কমেছে। বিগত ৯ বছরের মধ্যে গত অর্থবছরেই সর্বনিম্ন পরিমাণের রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। অথচ এই সময়ে প্রবাসে কর্মসংস্থানের পরিমাণ কিন্তু আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিদেশ গমন করেছেন, যা বিগত তিন দশকের মধ্যে রেকর্ড। প্রবাসে কর্মসংস্থান বাড়ার পরও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা জানান, বিষয়টি নিয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক খুবই উদ্বিগ্ন। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে উপায় বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। রেমিট্যান্স বাড়াতে বিবিএস তিনটি সুপারিশ করেছে। এক. বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেভাবে প্রবাসী আয় দেশে আনে, সেভাবে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন বা মানিগ্রাম, মোবাইল ব্যাংকিং বা বিকাশ, ডাকঘর ইত্যাদির মাধ্যমে প্রেরিত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে প্রতিফলনের ব্যবস্থা করা। দুই. প্রবাসী আয় প্রেরণের ক্ষেত্রে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা। পুরো বছরে মোট প্রেরিত অর্থের ওপর ৫ ভাগ প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। এটা করা গেলে, প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দেড় বিলিয়ন ডলার থেকে দুই বিলিয়ন ডলার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিন. বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের বাজারে বিনিময় হার ভাসমান মুদ্রানীতির আলোকে পরিচালনা করলেও ক্রয়-বিক্রয় মূল্যের অত্যধিক পার্থক্য প্রশমনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাজার পরিবীক্ষণের ভিত্তিতে এ হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আন্তঃব্যাংক বিনিময় হারের ক্ষেত্রে ক্রয়-বিক্রয় মূল্যের তারতম্য নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এসব পরামর্শের ভিত্তিতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, প্রবাসী আয়ে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যাবে না। কারণ তাতে দ্বৈত মুদ্রা বিনিময় হার হয়ে যাবে। তাই ব্যাংক, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন-মানিগ্রাম, বিকাশ ও ডাকঘরের মাধ্যমে যে রেমিট্যান্স আসে, সেখানে খরচ কমাতে হবে। আর সে বিষয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। বিবিএসের জরিপে আরও দেখা যায়, ২০১৬ সালে রেমিট্যান্সের ১২ দশমিক ৬৬ ভাগ এসেছে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন ও মানিগ্রামের মাধ্যমে। এছাড়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ, ডাকঘরের মাধ্যমে শূন্য দশমিক ২১ শতাংশ, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ, হুন্ডির মাধ্যমে ১২ দশমিক ৩১ শতাংশ, পরিচিত কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং অন্যান্য মাধ্যমে শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে।