প্রথমে শখের বশে শুরু করলেও এখন বেশ সুনামের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করছেন কাজী সিনথিয়া এবং সাজিয়া আফরিন চৌধুরী। মূলধারার ব্রিটিশ মডেলিংয়ে পিছিয়ে থাকলেও প্রবাসে তাদের মডেলিং ও গ্লামার জগতের অভিজ্ঞতা জানা হলো দুজনের সঙ্গে আলাপচারিতায়।
নিতান্ত শখ থেকে র্যাম্পে হাঁটা আর সেখান থেকে বাঙালি কমিউনিটিতে ধীরে ধীরে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন কাজী সিনথিয়া।
ছয় বছর আগে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করতে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান তিনি। গ্রিনউইচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় স্নাতক শেষ করে এখন চাকরি করছেন একটি লেটিং এজেন্সিতে (বাড়িওয়ালা এবং ভাড়া বা ইজারাদার মধ্যস্বত্ত্বভোগী প্রতিষ্ঠান)।
মডেলিং আসা প্রসঙ্গে সিনথিয়া জানান, ছোটবেলা থেকেই গান, নাচ আর কবিতা আবৃত্তিতে আগ্রহ তার। মায়ের হাত ধরে শিশু একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণও নেওয়া শুরু করেন তিনি।
স্কলাস্টিকা থেকে 'ও' লেভেল শেষ করে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমালেও ভুলে যাননি তিনি তার শেকড় আর সংস্কৃতি। দুই বছর আগে এক বন্ধুর অনুরোধে প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান সিনথিয়া।
এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মডেলিং ও র্যাম্পে হাঁটা নিয়েই ব্যস্ত রয়েছেন এখন। বিসিএ অ্যাওয়ার্ড এবং বেঙ্গলি ব্রাইডাল শো এখন পর্যন্ত করা সিনথিয়ার বেস্ট শো।
দেশ থেকে ভালো কাজের অফার আসলে সেখানেও ছুটে যাবেন বলে জানান তিনি।
কথা প্রসঙ্গে সিনথিয়া বলেন, "প্রথম দিকে বাড়তি ওজনের কারণে অনেকগুলো ভাল ইভেন্ট থেকে ছিটকে পড়তে হয়। তবে তাতে একবিন্দুও হতাশ হইনি। বরং নতুনভাবে তৈরি করেছি নিজেকে।"
তিনি জানান, সপ্তাহে ৩-৪ দিন কয়েক ঘণ্টা সময় খরচ করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। বাড়তি ওজন আর মেদ কমাতে প্রতিদিন অনুসরণ করতে হচ্ছে খাবারের কঠিন নিয়ম বা ডায়েট।
সিনথিয়ার মতে, আগ্রহ আর অনুশীলন থাকলে যে কেউ যে কোন পেশায় আসতে পারেন। "যত বাধা বিপত্তি আসুক না কেন, কখনও যেনো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু কমপ্রোমাইজ করা না হয় সেদিকটা সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে সবাইকে", বলেন তিনি।
তিনি বলেন, "অনেকের ধারণা মিডিয়াতে থাকা মানে সবকিছু অনেক সহজলভ্য। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করা হয়। বাছবিচার ছাড়াই অনেকে নেতিবাচক আর তীর্যক মন্তব্য করে বসেন। "
সিনথিয়া জানান, মাঝে-মধ্যে নানা ধরনের কটু কথার শিকারও হতে হয়েছে তাকে। একবার র্যাম্প শো চলার সময়ে তাকে এক লোক কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করেন। তিনি এর প্রতিবাদ করেন এবং পাল্টা জবাব দেন।
সিনথিয়া বলেন, "বিলেতে যেসব মেয়েরা পড়তে আসেন তারা নিজ দেশের সংস্কৃতি ও রীতি-প্রথাকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন। এখানে পড়ালেখা শেষ করে আমি জব করে নিজের খরচ নিজে চালাচ্ছি।"
"বিয়ে করিনি অর্থাৎ সিঙ্গেল, পাশাপাশি মডেলিং করছি বলে আমি আমার গায়ে 'অ্যাভাইলেবল' লেবেল সেটে রাখিনি", ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন সিনথিয়া।
তার মতে, প্রত্যেক মেয়েকে নিজের অধিকার আর সম্মানের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে এবং সেই সঙ্গে হতে হবে আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী। মনে রাখতে হবে আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করতে কিছু বাজে লোক সব সময়ই আশপাশে থাকেন।
"নিজের পায়ে দাড়িঁয়েছি বলেই নিম্ন মানসিকতার মানুষ আমার সামনে এসে কথা বলতে সাহস পায় না।"
গুটিকয়েক মানুষের জন্য পুরো কমিউনিটি থেকে দূরত্ব বজায় রাখাটা বোকামি বলে মনে করেন সিনথিয়া।
বরং প্রবাসী বাঙালি কমিউনিটিকে অসম্ভব সুন্দর কিছু শো আর ইভেন্ট আয়োজন করার জন্য ধন্যবাদ জানান তিনি।
উৎসাহ, উদ্দীপনা আর সাহসের যোগান সেই ছোটবেলা থেকে দিয়ে যাচ্ছেন সিনথিয়ার মা। নিজের পরিবার আর মায়ের নাম উজ্জ্বল করতে ভালো ভালো কাজ করার প্রত্যয় জানালেন সিনথিয়া।
এদিকে মডেলিং শখ হিসেবে নিলেও এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া বোকামি হবে বলে মনে করেন প্রবাসের আরেক বাঙালি মডেলকন্যা সাজিয়া আফরিন চৌধুরী।
তার মতে, বিলেতে বাঙালি কমিউনিটি বেশ কিছু ভালো ইভেন্টের আয়োজন করেছে। তবে দেশের মিডিয়ার মতো এখনও পুরোপুরি পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি।
"এখানে সবকিছুতে ভালো কাজের প্রশংসা করা হয়। তবে জীবন-নির্বাহের জন্য মডেলিংকে পেশা হিসেবে নেওয়া যায় না। কারণ 'সম্মানি' নিয়ে বেশ একটা বিভ্রান্তি আছে এখানে। এখানকার বেশির ভাগ শো আর ইভেন্টগুলো মূলত স্পন্সরভিত্তিক। আয়োজকরা সঠিক স্পন্সর না পেলে শিল্পীদের সম্মানিতে টান পড়ে।"
তবে অদূর ভবিষ্যতে এ সমস্যার সমাধান হবে, এমনটাই আশা সাজিয়ার।
এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বড় ইভেন্টে কাজ করেছেন তিনি। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- লন্ডন ওয়েডিং ফেয়ার আর বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত বেঙ্গলি ওয়েডিং ফেয়ার।
টিভিতে পণ্যের বিজ্ঞাপন নিয়েও খানিকটা হতাশা সাজিয়ার অভিব্যক্তিতে- "একদিকে রেম্যুনোরেশন অন্যদিকে বিজ্ঞাপন নির্মাতার কাজের অবস্থা দেখে সেই পথে হাঁটতে ইচ্ছে করে না।"
সফলতার সঙ্গে নানা শো করলেও ব্রিটেনের মূল ঘরানার কাজ করতে না পারায় মনে খানিকটা আক্ষেপ আছে সাজিয়ার। আর এর পেছনে উচ্চতা সমস্যা দায়ি বলে জানালেন সাজিয়া।
"এখানকার মডেলদের সর্বনিম্ন উচ্চতা ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি। সেখানে আমাদের দেশের মেয়েদের উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। অডিশন সব ঠিক দেওয়ার পরও শুধু উচ্চতার কারণে বাদ পড়তে হয়।"
মজা করে সাজিয়া জানান, ডায়েট করে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও উচ্চতা বাড়ানোর কোন টেকনিক জানা নেই তার। তাহলে অনেক মডেলকন্যারই এই ইচ্ছে পূরণ করতেন সাজিয়া।
বাঙালি কমিউনিটির সবার সঙ্গেই সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আছে তার।
তবে কিছুটা অভিযোগের সুরে সাজিয়া বলেন, "মিডিয়াতে মেয়েদের কাজ করাকে এখনও অনেকে ভাল চোখে দেখেন না। যতই বিলেতে থাকুক না কেনো, স্বভাব-চরিত্রে এখনও নিচু মানসিকতার পরিচয় দেন।"
"অনেকে হেয় করার জন্য কটু মন্তব্য করেন। সেইসব মানুষকে বলতে ইচ্ছে হয়, মডেলিং আমার জন্য নতুন কিছু নয়। সেই ২০০৪ সাল থেকে শখের বশে মডেলিং আর র্যাম্পে কাজ করছি।"
২০০৪ সালে ফটো প্রতিযোগিতায় রানার আপ হয়ে সাজিয়ার মিডিয়ায় পথচলা। বেশ কিছু বিজ্ঞাপন আর নাটকেও কাজ করা হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই গান আর নাচে তালিম নেওয়ায় মিডিয়াতে তার পথচলা মসৃণ হয়েছে বেশ খানিকটা।
তবে পড়ালেখার কারণে ২০০৯ সালে ব্র্রিটেনে আসার পর কিছুটা ভাটা পড়ে বলে জানালেন তিনি।
অ্যাঙ্গলিয়া রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করে গত দুই বছরে টানা কাজ করার সুবাদে বাঙালি কমিউনিটিতে পরিচিত মুখ এখন সাজিয়া।
বড় বোন সাদিয়া আফরোজ ব্রিটেনের বাঙালি সঙ্গীতাঙ্গনে সুনাম কুড়িয়েছেন বহু আগে থেকেই। তার কাছ থেকে সব সময় সাহস আর অনুপ্রেরণা পান বলে জানালেন তিনি।
বিবিএ আর এমবিএ শেষ করে বর্তমানে একটি হিসাবরক্ষণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন সাজিয়া। ইচ্ছে আছে মিডিয়াতে নিজের অবস্থান শক্ত করার। যুক্তরাজ্যের মূলধারার মডেলিং-এ সিনথিয়া ও সাজিয়া নন্দিত হবেন, এটাই প্রত্যাশা।
সংগ্রহীত