মরিচ চাষঃ
বিভিন্ন প্রকার রান্নার জন্য মরিচ একটি অপরিহার্য উপাদান। মরিচকে অর্থকরী ফসল বলা হয়। এর ইংরেজি নাম Chilli ও বৈজ্ঞানিক নাম Capsicun annuum. বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে মরিচের চাষ করা হয়। তবে চরাঞ্চালে মরিচের উৎপাদন বেশি হয়। আমাদের দেশের অনেক জায়গায় এখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে মরিচ চাষ ও বাজারজাত করা হচ্ছে। একজন বেকার নারী বা পুরুষ নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য নিজের জমিতে অথবা বর্গা নেওয়া জমিতে মরিচ চাষ করে ব্যবসা শুরু করতে পারেন।
পুষ্টিগুনঃ
মরিচে ভিটামিন সি আছে।
বাজার সম্ভাবনাঃ
বিভিন্ন তরকারিতে মরিচ মসলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তরকারির স্বাদ বাড়ানোর জন্য মরিচ ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে সাধারণত মরিচ ছাড়া কোন তরকারি রান্না করা চিন্তা করা হয় না। মরিচ সালাদে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য মরিচের সসের অনেক চাহিদা রয়েছে। মরিচ চাষ করে বাড়তি আয় করা সম্ভব। ব্যাপকভাবে মরিচ চাষ করলে তা বিদেশেও রপ্তানি করার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। মরিচ বিদেশে রপ্তানি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
মরিচ উৎপাদন কৌশলঃ
* চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটি
জলবায়ু
মাটির প্রকৃতি
সাধারণত মরিচ রবি মৌসুমে বেশি চাষ করা হয়। তবে ভাদ্র মাসেও কিছু কিছু মরিচ চাষ করা হয়।
যথেষ্ট সূর্যালোক পড়ে এবং বাতাস আছে এ ধরণের উঁচু এবং মুক্ত জমি চাষের জন্য উপযোগী। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন বেলে দোঁআশ থেকে এঁটেল দো-আঁশ মাটি মরিচ চাষের জন্য ভালো। তবে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ বা পলি দো-আঁশ মাটি মরিচ চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
জাতঃ
১. বাংলাদেশে অসংখ্য জাতের মরিচ চাষ হয়।
২. সাধারণভাবে এগুলোর বিশেষ কোন নাম নেই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের নামও আছে।
৩. খুবই ছোট আকারের একটি মরিচ রয়েছে যাকে ধানি মরিচ বলা হয়।
৪. কামরাঙ্গা মরিচ নামে এদেশে একটি জাত আছে, এটি অত্যন্ত ঝাল এবং উপবৃত্তাকার। কোন কোন জেলায় একে বোম্বাই মরিচ বলা হয়।
ব্যবহারিক দিক থেকে মরিচকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ঝাল মরিচ ও ঝালবিহীন মরিচ (ক্যাপসিকাম)।
ঝাল মরিচ : এশিয়া, চীন এবং মধ্য আফ্রিকার দেশসমূহে ঝাল মরিচ ও ঝালবিহীন মরিচ (ক্যাপসিকাম)-এই দুই ধরণের মরিচ চাষ করা হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন আকার এবং আকৃতির মরিচ চাষ করা হয়। মূলত কাঁচা মরিচ যা কম-বেশি ঝালযুক্ত তা রান্নায় ব্যবহার করা হয়। একইসাথে শুকনা মরিচ যা দেখতে লম্বাটে ধরণের তাও ব্যবহার করা হয়। শুকনা মরিচ গুঁড়ো অথবা শিল-পাটায় বেটে রান্না করা হয়। মরিচের সস ব্যাপকহারে বিপণন করা হয়।
ঝালবিহীন মরিচ (ক্যাপসিকাম) : উপমহাদেশে এ ধরণের মরিচকে সিমলা মরিচ বলা হয়। এ মরিচ সাধারণত আকরে বড় এবং পুরু। এ মরিচকে সবজি হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং সালাদেও ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে এ মরিচ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় এবং এটি একটি উচ্চমূল্য সম্পন্ন শস্য।
চারা রোপণ/বীজ বপন পদ্ধতিঃ
১. শীত মৌসুমের জন্য ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এবং গ্রীষ্ম মৌসুমের জন্য ফাল্গুন-চৈত্রের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে চারা তৈরির জন্য বীজ বপন করা হয়।
২. মরিচের চারা ৪-৫টি পাতা গজালে রোপণ করা যায়।
৩. মরিচের চারা সারিবদ্ধভাবে ৬০-৭৫ সে.মি. দূরত্বে রোপণ করা হয়।
৪. একটি চারা থেকে আর একটি চারা ৬০-৭৫ সে.মি. দূরত্বে রোপণ করা হয়।
সার প্রয়োগঃ
কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে মরিচ চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশে-পাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদি স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সেচঃ
১. শুকনা মৌসুমে মরিচে পানি সেচ খুবই উপকারী। শীত ও খরার সময় জমিতে ১৫ দিন পরপর সেচ দিতে জমে।
২. পানির অভাব হলে ফলন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।
৩. আবহাওয়া ও মাটির অবস্থাভেদে সেচই মরিচের জন্য যথেষ্ট।
চাষের সময় পরিচর্যাঃ
১. জমিতে আগাছা থাকলে পোকামাকড়, রোগজীবাণু ও ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। তাই বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার নিড়ানী দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
২. মাটিবাহিত রোগে মরিচ বেশি আক্রান্ত হয়। এজন্য একই জমিতে বছরে একবারের বেশি মরিচ চাষ করা ঠিক নয়।
রোগবালাইঃ
১. প্রজেনিয়া, লিটুরিয়া, কাপামোটাস কমপ্রেসাস এবং প্রস্টক্সেল মরিচের প্রধান ক্ষতিকারক কীট।
২. রোগের মধ্যে ডাই-হ্যাক অন্যতম।
৩. সষ্টরটও মরিচ গাছের ক্ষতি করে।
প্রতিকারঃ
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
ফসল সংগ্রহঃ
সাধারণত মরিচের চারা রোপনের ৬০ দিন পর মরিচ সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।
উৎপাদিত ফসলের পরিমাণঃ
প্রতি বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি থেকে প্রায় ১২ মণ মরিচ পাওয়া সম্ভব।
বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণঃ
১. পাকা মরিচ ১৫ দিন পর পর সংগ্রহ করা যায়।
২. মরিচের গাছ নির্বাচন করে পরিপূর্ণ পাকা মরিচ সংগ্রহ করতে হবে।
৩. তারপর তা ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে বীজ বের করে নিতে হবে।স
৪. বীজ শুকিয়ে আর্দ্রতা ৬-৮% করে নিয়ে বায়ুরোধী পাত্র বা পলেথিন প্যাকেটে সংরক্ষণ করতে হবে।
মরিচ উৎপাদন খরচঃ
* ১বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে ফসল উৎপাদন খরচ
খরচের খাত |
পরিমাণ |
আনুমানিক মূল্য (টাকা) |
১। বীজ/চারা |
৫০০০ চারা |
১৫০০ |
২। পানি সেচ |
৩ বার |
১৫০০ |
৩। শ্রমিক |
৩০জন (প্রতিজন=১৫০ টাকা) |
৪৫০০ |
৪। সার |
প্রয়োজন অনুসারে জৈব সার** |
২১৬৭ |
|
**এই সার বাড়িতেই তৈরি করা সম্ভব। |
|
|
টিএসপি=৪৩ কেজি (১ কেজি=২৫ টাকা) |
|
|
ইউরিয়া=২৮ কেজি (১ কেজি=১৩ টাকা) |
|
|
এমপি=২৬ কেজি (১ কেজি=২৮ টাকা) |
|
|
|
|
৫। কীটনাশক
|
প্রয়োজন অনুসারে জৈব বা রাসায়নিক |
|
৬। নিজস্ব/দোকান/জমি ভাড়া |
একবছর |
৪০০০ |
***মাটির জৈব গুণাগুণ রক্ষা ও উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য জৈব সার ও জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে লাভের পরিমাণ বাড়তে পারে।
মূলধনঃ
এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে মরিচ চাষের জন্য প্রায় ১০০০০ টাকার (কম-বেশী) টাকার প্রয়োজন হবে। মূলধন সংগ্রহের জন্য ঋণের প্রয়োজন হলে নিকট আত্মীয়-স্বজন, সরকারী ও বেসরকারী ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান (এনজিও)-এর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। এসব সরকারি ও বেসরকারি ঋণদানকারী ব্যাংক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) শর্ত সাপেক্ষে ঋণ দিয়ে থাকে।