ভারতে খ্রিস্টানরা তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন পালনে বিভিন্ন কট্টরপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীর দিক থেকে বাধার মুখে পড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মধ্যপ্রদেশের সাতনায় গত সপ্তাহে ক্রিসমাস ক্যারল গাওয়ার সময় বজরং দলের কর্মীরা একদল খ্রিস্টানের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ পরে ওই গায়কদেরই গ্রেফতার করে।
সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) হিন্দু জাগরণ মঞ্চ নামে আর একটি সংগঠন উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে বলেছে, স্কুলে হিন্দু ছাত্রদের কিছুতেই বড়দিন পালনে সামিল করা যাবে না। এই ধরনের নানা ঘটনার পটভূমিতে ভারতে ক্যাথলিক বিশপদের সর্বোচ্চ সংগঠন মনে করছে, বড়দিন পালনের ক্ষেত্রে তাদের এই ধরনের হুমকিতে আগে কখনও পড়তে হয়নি।
মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলায় চার-পাঁচদিন আগে গ্রামের রাস্তায় ক্রিসমাস ক্যারল গাইতে গাইতে যাচ্ছিলেন দুজন যাজক-সহ একদল খ্রিস্টান। আচমকাই উগ্র হিন্দুত্ববাদী বজরং দলের কিছু লোকজন তাদের রাস্তা আটকে অভিযোগ তোলে, তারা এলাকায় ধর্মান্তরণ করছেন। পুলিশ এসে ওই খ্রিস্টানদেরই গ্রেফতার করে, হামলাকারীরা তাদের একটি গাড়িও জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করে ক্যাথলিক বিশপস কনফারেন্স অব ইন্ডিয়া বলেছে, দেশের নানা প্রান্তে এই ধরনের ঘটনা তাদের গভীরভাবে বিচলিত করে তুলেছে।
কনফারেন্সের সেক্রেটারি জেনারেল বিশপ থিওডোর মাসকারেনহাস জানান, "এ দেশে এখন যা ঘটছে তা অত্যন্ত দু:খজনক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা ঐতিহ্য আছে ভারতে, এবং অতীতে ওড়িশার কান্ডামাল আর গুজরাটের ডাং এলাকায় কিছু ঘটনা ছাড়া কখনও ভারতে খ্রিস্টানদের এমন হামলার মুখে পড়তে হয়নি। ভারতে তারা চিরকাল নির্ভয়ে বড়দিন পালন করে এসেছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মবোক্রেসি বা জনতার অরাজকতাই যেন দেশকে চালাচ্ছে।"
মধ্যপ্রদেশের ওই ঘটনায় পুলিশ ছজন ক্যারল গায়কের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে ২৯৫এ ধারায় চার্জও এনেছে। এদিকে দেশের আর এক বিজেপি-শাসিত রাজ্য উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ নামে আর একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে রীতিমতো নোটিশ পাঠিয়ে নির্দেশ জারি করেছে - বড়দিন উপলক্ষে হিন্দু বাচ্চাদের যেন স্কুলের কোনও উৎসবে সামিল না-করা হয়।
জাগরণ মঞ্চের সভাপতি সোনু সবিতার বক্তব্য, বড়দিন পালনের নামে খ্রিস্টান সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না। তিনি বলছিলেন, "বিপদটা হল স্কুল কর্তৃপক্ষ বাচ্চাদের স্কুলের ডায়েরিতে লিখে পাঠাচ্ছে তোমাদের সান্তাক্লজের পোশাক, ক্রিসমাস ট্রি, কেক-চকোলেট-টফি এটা সেটা নিয়ে আসতে হবে, নইলে জরিমানা হবে। আর এটা শুধু ক্যাথলিক স্কুলে নয়, প্রায় সব স্কুলেই। তাই আমরা পরিষ্কার বলেছি, খ্রিস্টান বাচ্চাদের নিয়ে যা খুশি কর - কিন্তু হিন্দু বাচ্চাদের কিছুতেই তোমরা এভাবে জোর করে বড়দিন পালন করাতে পার না!"
বিশপ মাসকারেনহাসের মতে, জাগরণ মঞ্চের মতো ছোটখাটো অনামী সংগঠনও এখন কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে - বিপদটা সেখানেই। তিনি বলছিলেন, "এই গোষ্ঠীগুলো আগে এখানে-সেখানে ছুটকো-ছাটকা কিছু ঘটনা ঘটিয়ে বেড়াত - কিন্তু এখন তাদের শুধু সাহসই নয়, আমি বলব স্পর্ধাও বেড়ে গেছে। সরকারের কাছ থেকে আমরা বরাবর সহযোগিতা পেয়ে এসেছি, কিন্তু যখন এই ধরনের লোকজন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তখন সাধারণ নাগরিকের সুরক্ষা কোথায় যায়?"
শুধু সাধারণ খ্রিস্টানরাই নয়, মহারাষ্ট্রের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাডনবিসের স্ত্রী পর্যন্ত দিনকয়েক আগে বড়দিন থিমে আয়োজিত একটি চ্যারিটি ইভেন্ট সাপোর্ট করে সোশ্যাল মিডিয়াতে তোপের মুখে পড়েছিলেন। "আপনি কি গোপনে খ্রিস্টান হয়েছেন না কি?" তাকে এ ধরনের মন্তব্যও শুনতে হয়েছে। তবে বিজেপির মুখপাত্র অনিলা সিং দাবি করছেন, খ্রিস্টান সংস্কৃতির ওপর এই ধরনের হামলাকে বিজেপি মোটেও সমর্থন করে না। তার যুক্তি, "বিজেপির চিন্তাধারা ও মানসিকতায় এই ধরনের দাবির কোনও ঠাঁই নেই - আমরা সব ধর্মের উৎসব মিলেমিশে পালন করাতেই বিশ্বাসী। আমি নিজে ক্যাথলিক কনভেন্ট স্কুলে পড়া সত্ত্বেও নিজেকে সাচ্চা হিন্দু বলেই মনে করি।"
"আর যে সব লোকজন বড়দিনের বিরুদ্ধে স্কুলে ফতোয়া পাঠাচ্ছেন, আমি বলব স্কুলগুলোর উচিত তাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করা", বলছেন অনিলা সিং। কিন্তু ঘটনা হল, আলিগড়ে পুলিশ এখনও হিন্দু জাগরণ মঞ্চের নেতাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। আর ভারতের প্রায় আড়াই কোটি খ্রিস্টানও দুর্ভাবনায় পড়েছেন, তাদের বড়দিন এবারে নির্বিঘ্নে কাটবে কি না।
সূত্র: বিবিসি বাংলা