গরু মোটাজাতকরণ প্রকল্প প্রতিটি পরিবার কিংবা ব্যক্তির একক বা একমুখী রোজগারে সংসার চালানো অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অনেকেই বাড়তি একটা কিছু করতে চায়, কিন্তু সুযোগ হয় না কিংবা হলেও কি করবে, তা খুঁজে পায় না। মোটাজাতকরণের জন্য গরু কিনতে গিয়ে কয়েকটি দিক খেয়াল রাখতে হবে, যেমন: ১) ১ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে গরু কিনতে হবে (১২-১৫ মাস বয়সের গরু মোটাজাতকরনের জন্য ভালো) ২) গায়ের চামড়া ঠিলা-পাতলা, পাঁচরের হাড় চেপ্টা, পায়ের মোট এবং শুধু মাত্র খাবারের অভাবে যে সব গরু শুকিয়ে গেছে এমন গরু কম মূল্যে কিনতে হবে। ৩) মনে রাখতে হবে গর্ভবতী গাভীকে ইউরিয়া মিশ্রিত খড় খাওয়ানো যাবে না। নির্বাচিত গরুকে প্রকল্প মতে প্রক্রিয়াজাত ইউরিয়া মিশ্রিত খড় খাওয়ানোর পূর্বে কিছু চিকিৎসা দিয়ে উপকুক্ত করে নিতে হবে। ক. গরুর শরীরে কোনো ক্ষত থাকলে সে স্থানে ডেটল বা স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে পরিস্কার করে নেগোভোন মলম লাগিয়ে প্রয়োজনে ব্যাণ্ডেজ করে রাখতে হবে, যাতে ক্ষত স্থানে মশা-মাছি কিংবা ময়লা জমতে না পারে। খ. ক্ষত গভীর হলে তা না শুকানো পর্যন্ত আবার পরিস্কার করে মাঝে মধ্যেই মলম ব্যবহার করতে হবে। গ. ক্ষত সেরে যাওয়ার পর গরুর গায়ের সেসব পরজীবী যেমন-উকুন, আঠালি, সিঁদুর পোকা ইত্যাদি মুক্ত করতে হবে। নিয়মাবলীঃ একটি গরুর জন্য নিউসিডল বা এনোসটোল পাউডার ১০ কেজি পানিতে ২.৫ চা চামচ মিশাতে হবে। তারপর বাসতি থেকে কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে প্রথমে ভালোভাবে নাক-মুখ বেঁধে কান, চোখ, মুখ ছাড়া শরীরের সর্বত্র ওষুধ মিশ্রিত পানিতে ভিজিয়ে কানের ভেতর, চোখের চতুপারর্শ্বে, নাক, মুখ লেজের গোড়া, শরীরের সঙ্গে পায়ের সংযোগস্থলসহ সকল সংকীর্ণ জায়গায় লাগাতে হবে। ওধুষ লাগিয়ে ২০-২৫ মিনিট অপেক্ষা করার পরে পরিস্কার পানি দ্বারা শরীরের সর্বত্র ভালোভাবে ধুয়ে ওষুধমুক্ত করতে হবে। ওষুধ লাগানোর ২/১ দিন পর যদি দেখা যায় ভালোভাবে বাহিত্যক পরজীবী মুক্ত হয়নি তবে ১৫ দিন পরে আবার একই নিয়মে ওষুধ লাগাতে হবে। সর্তকতা ১. যে ব্যক্তি ঔষুধ লাগাবেন, তিনি গরুর শরীরের ক্ষতস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকবেন, কারণ এই ঔষুধ বিষ জাতীয়। ২. গরুর শরীরে ক্ষতস্থানকে (যদি ভালোভাবে না শুকিয়ে তাকে) এড়িয়ে ঔষদ প্রয়োগ করতে হবে। ৩. গরুকে ঔষুধ প্রয়োগের পর ভালোভাবে গোসল করিয়ে উক্ত স্থান থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে মুখের বাঁধন খুলতে হবে কারণ গরু স্বভাবত ঔষুধ লাগা ঘাস বা পানি খেয়ে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। অভ্যন্তরীণ পরজীবী মুক্ত করণ ১. গোল কৃমি ২. কলিজা বা পাতা কৃমি। গোল কৃমি গোল কৃমি মুক্ত করতে নিচের যে কোন একটি ঔষুধ ব্যবহার করা যায় মেনাফেঙ্ পাউডার = ১ প্যাকেট ১টি গরুর জন্য অথবা নেমাফেক্স বড়ি = ৩টি বড়ি একটি পূর্ণ বয়স্ক গরুর জন্য = ২টি বড়ি মাঝারি ও ছোট বাছুরের জন্য অথবা কোপেন পাউডার = ১টি প্যাকেট একটি গরুর জন্য অথবা রিনটাল পাউডার = ৭.৫ মি গ্রাম প্রতি কেজি দৈহিক ওজনের জন্য বিঃদ্রঃ রিনটাল পাউডার ব্যবহার করা সবচেয়ে ভাল কারণ এই ঔষুধে ছোট বড় মাঝারি সব ধরনের কৃমি মারা যায়। গোল কৃমির ঔষুধ খাওয়ানোর পরে সবল গরু ৩ দিন এবং অন্যান্য গরুর ক্ষেত্রে ৭দিন অপেক্ষা করে তবে পাতা কৃমির ঔষুধ প্রয়োগ করতে হবে। ২. কলিজা বা পাতা কৃমি মুক্তকরণের নিয়মাবলী চামড়ার নিচে টোডাক্স ইনজেকশন করতে হবে। মাত্রা সাধারণভাবে ২/৩ সিসি প্রাপ্তবয়স্ক গরুর জন্য। মোটাতাজা করতে হলে ঙ্গ সিসি পরিমান ইনজেকশন করতে হয়। এই ঔষুধ প্রয়োগের ৩ দন অপেক্ষা করার পরে ইউরিয়া মিশ্রিত খাবার খাওয়ানো আরম্ভ করতে হবে। টোডাঙ্ ইনজেকশন ৭ দিন পর পর ২ বার দিতে হবে এবং তখন খাবার বন্ধ করার কোনো প্রয়োজন নাই। গরুকে প্রদানের জন্য দানাদার খাদ্যের মিশ্রণ তৈরির নিয়মঃ ১. নং মিশ্রণ ক. তিলের খৈল = ৪ কেজি খ. চালের কুঁড়া = ৪ কেজি গ. গমের ভূষি = ৪ কেজি ঘ. যে কোন ডালের ভূষি = ৪ কেজি ২নং মিশ্রণ ক. গম ভাঙ্গা =৪কেজি খ. তিলের খৈল = ৪ কেজি গ. চালের কুঁড়া = ৪ কেজি ঘ. ডাল ভাঙ্গা, খেসারি = ৪ কেজি কৃমি দূর করার পরে গরুকে ইউরিয়া মিশ্রিত উন্নত খাবার দিতে হবে। গরুকে সাধারণত তিনটি পদ্ধতিতে মিশ্রিত উন্নত খাবার দিতে হবে। ১। আঁশ জাতীয় খড় খাদ্যের সাথে মিশিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে ২। দানাদার জাতীয় খাদ্যের সাথে সরাসরিভাবে এবং ৩। ইউরিয়া মোলাসেস বুকের মাধ্যমে খড়ের সাথে মিশিয়ে ইউরিয়া খাওয়ানোর নিয়ম খড় প্রক্রিয়াজাতকরণ ১০ কেজি খড় ১০ কেজি পানি এবং ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া বায়ুরোধী বড় বাঁশের ডোল (পাত্রবিশেষ) বা ইটের তৈরি হাউজে ৭-১০ দিন আবদ্ধ বায়ুরোধী অবস্থায় রেখে দিতে হবে। তারপর ঐ খড় বের করে রৌদ্রে শুকিয়ে নিতে হবে যেন ইউরিয়া তীব্র গন্ধ কিছুটা কমে আসে। এই খড় গরু প্রথমে না খেলে কিছুটা চিড়াগুড় মিশিয়ে দেয়া যেতে পারে (২০০-৫০০ গ্রাম) গরুকে প্রথমে দৈনিক ৫ গ্রাম থেকে শুরু করে সবের্াচ্চ ৫০-৬০ গ্রাম ইউরিয়া খাওয়ানো যায়। ছোট গরুর ক্ষেত্রে ৩০-৪০ গ্রামের বেশী দৈনিক খাওয়ানো উচিত নয়। দানাদার খাদ্যে ইউরিয়া ব্যবহার করে বিভিন্ন ওজনের গবাদি পশুর দৈনিক খাদ্যের তালিকা। ১০০ কেজি দৈহিক ওজনের গবাদিপশুর খাদ্য তালিকা। ধানের খড় = ২ কেজি সবুজ ঘাস = ২ কেজি (ঘাস না থাকলে খড় ব্যবহার করতে হবে দানদার খাদ্যে মিশ্রন = ১.২-২.৫ কেজি ইউরিয়া = ৩৫ গ্রাম (নিয়মানুযায়ী) চিটাগুড়া = ২০০-৪০০ গ্রাম লবণ = ২৫ গ্রাম দানাদার খাদ্যের সাথে লবন, ইউরিয়া, চিটাগুড় এক সাথে মিশিয়ে দিনে ২ বার দিতে হবে। ধানের খড় এবং কাঁচা ঘাস ছোট ছোট করে কেটে এক সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়। ১৫০ কেজি ওজনের গবাদিপশুর খাদ্য তালিকা খড় = ৩ কেজি কাঁচা ঘাস = ৫-৬ কেজি দানাদার খাদ্যের মিশ্রন = ১.৫-২ কেজি চিটাগুড় = ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া = ৪৫ গ্রাম (নিয়মানুয়ায়ী) লবন = ৩৫ গ্রাম ১৫০-২০০ কেজি ওজনের পশুর খাদ্য তালিকা ধানের খড় = ৪ কেজি কাঁচা ঘাস = ৫-৬ কেজি দানাদার খাদ্যের মিশ্রন = ১.৫-২ কেজি চিটাগুড় = ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া = ৪৫ গ্রাম (নিয়মানুযায়ী) লবন = ৩৫ গ্রাম মোটাতাজা করনের গরুকে সর্বক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁশ জাতীয় খাবার (খড়, কাঁচা ঘাস) এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। গবাদীপশুকে ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত খাবার প্রদানে কিছু কিছু সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত। ১। এক বছরের নিচে গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না। ২। কখনও মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না ৩। গর্ভাবস্থায় ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না। ৪। অসুস্থ গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না, তবে দূর্বল গরুকে পরিমাণের চেয়ে কম খাওয়ানো যেতে পারে। ৫। ইউরিয়া খাওয়ানোর প্রাথমিক অবস্থা (৭ দিন পর্যন্ত পশুকে ঠান্ডা ছায়াযুক্ত স্থানে বেঁধে রাখতে হবে এবং ঠান্ডা পানি দিয়ে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। প্রকল্প মেয়াদ তিন মাস, শুরু হবে ইউরিয়া মিশ্রিত খাবার প্রদানের দিন থেকে। এই খবার খাওয়ানো শুরুর ১০-১৫ দিন পর হেমাটোপিন বিএস (১০এমএল) ইনজেকশন মাংসপেশীতে প্রয়োগ করলে মোটাতাজা করণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। উল্লেখিত তিনটি পদ্ধতির মধ্যে খড়ের প্রক্রিয়াজাত করে ইউরিয়া খাওয়ানো সহজ, ব্যয় কম এবং ফল ভালো আসে। এই প্রকল্পগুলো বিভিন্ন বয়সী হতে পারে। যেমন ৩ বা ৪ মাস মেয়াদি। নির্ভর করছে খামারি কেনা গরুটি কি রকম মোটা করে কি দামে বিক্রি করবেন। দাম বেশি চাইলে প্রকল্প মেয়াদ দীর্ঘ হবে এবং কম চাইরে প্রকল্প মেয়াদ স্বল্প হবে। তবে অনেকেই ঈদের বাজারকে চিন্তা করে তার ৪/৫ মাস আগে থেকে প্রকল্প শুরু করেন।